পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ২৩৭ আর যে-স্থষ্টিকর্তী ছালোকে ভূলোকে নানা রঙ নিয়ে রূপের লীলা করেন, তাকেও সহায় করবার চেষ্টা করছিল, এমন সময় শু্যাম এসে ওর স্বপ্ন-বোনা জালে ঘা মারলে। কুমু চোখ বুজে খুব জোর করে নিজেকে বলতে লাগল, ‘স্বামীর বয়স বেশি বলে তাকে ভালোবাসি নে এ কথা কখনোই সত্য নয়— লজ্জা লজ্জা ! এ যে ইতর মেয়েদের মতে কথা ! শিবের সঙ্গে সতীর বিয়ের কথা কি ওর মনে নেই ? শিবনিন্দুকর র্তার বয়স নিয়ে খোটা দিয়েছিল, কিন্তু সে কথা সতী কানে নেন নি । স্বামীর বয়স বা রূপ নিয়ে এ পর্যন্ত কুমু কোনো চিন্তাই করে নি। সাধারণত যে-ভালোবাসা নিয়ে স্ত্রীপুরুষের বিবাহ সত্য হয়, যার মধ্যে রূপগুণ দেহমন সমস্তই মিলে আছে, তার যে প্রয়োজন আছে এ কথা কুমু ভাবেও নি। পছন্দ করে নেওয়ার কথাটাকেই রং মাখিয়ে চাপা দিতে চায়। এমন সময় ফুলকাটা জামা ও জরির পাড়ওআল। ধুতি-পরা ছেলে, বয়স হবে বছর সাতেক, ঘরে ঢুকেই গা ঘেঁষে কুমুর কাছে এসে দাড়াল। বড়ো বড়ো স্নিগ্ধ চোখ ওর মুখের দিকে তুলে ভয়ে ভয়ে আস্তে আস্তে মিষ্টি স্বরে বললে, “জ্যাঠাইমা।” কুমু তাকে কোলের উপর টেনে নিয়ে বললে, “কী বাবা, তোমার নাম ?” ছেলেটি খুব ঘটা করে বললে, ঐটুকুও বাদ দিলে না, “শ্ৰীমোতিলাল ঘোষাল।” সকলের কাছে পরিচয় ওর হাবলু বলে। সেইজন্যেই উপযুক্ত দেশকালপাত্রে নিজের সম্মান রাখবার জন্যে পিতৃদত্ত নামটাকে এত স্বসম্পূর্ণ করে বলতে হয়। তখন কুমুর বুকের ভিতরটা টনটন করছিল— এই ছেলেকে বুকে চেপে ধরে যেন বঁাচল । হঠাৎ কেমন মনে হল কতদিন ঠাকুরঘরে যে-গোপালকে ফুল দিয়ে এসেছে, এই ছেলেটির মধ্যে সে-ই ওর কোলে এসে বসল। ঠিক যে সময়ে ডাকছিল সেই দুঃখের সময়েই এসে ওকে বললে, “এই যে আমি আছি তোমার সান্থনা।” মোতির গোল গোল গাল টিপে ধরে কুমু বললে, “গোপাল, ফুল নেবে ?” কুমুর মুখ দিয়ে গোপাল ছাড়া আর কোনো নাম বেরোল না। হঠাৎ নিজের নামান্তরে হাবলুর কিছু বিস্ময় বোধ হল— কিন্তু এমন স্থর ওর কানে পৌচেছে যে, কিছু আপত্তি ওর মনে আসতে পারে না। 幡 এমন সময়ে পাশের ঘর থেকে মোতির মা ছেলের গলা শুনতে পেয়ে ছুটে এসে বললে, “ওই রে, বদর-ছেলেট এসেছে বুঝি।” শ্ৰমোতিলাল ঘোষাল-এর সম্মান আর থাকে না। নালিশে-ভরা চোখ তুলে নিঃশঝে মায়ের মুখের দিকে সে চেয়ে রইল, ডান হাতে জ্যাঠাইমার আঁচল চেপে। কুমু হাবলুকে তার বা হাত দিয়ে বেড়ে নিয়ে বললে, “আহা, থাক না।”