পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

&ebr 场 রবীন্দ্র-রচনাবলী “না ভাই, অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন শুতে যাক— এ বাড়িতে ওকে খুব সহজেই মিলবে, ওর মতো সস্তা ছেলে আর কেউ নেই।” বলে মোতির মা অনিচ্ছুক ছেলেকে শোয়াবার জন্যে নিয়ে গেল। এই এতটুকুতেই কুমুর মনের ভার গেল হালকা হয়ে। ওর মনে হল প্রার্থনার জবাব পেলুম, জীবনের সমস্যা সহজ হয়ে দেখা দেবে এই ছোটো ছেলেটির মতোই। ২৩ অনেক রাত্তিরে মোতির মা এক সময়ে জেগে উঠে দেখলে কুমু বিছানায় উঠে বসে আছে, তার কোলের উপর দুই হাত জোড়া, ধ্যানাবিষ্ট চোখ দুটি যেন সামনে কাকে দেখতে পাচ্ছে। মধুসূদনকে যতই সে হৃদয়ের মধ্যে গ্রহণ করতে বাধা পায়, ততই তার দেবতাকে দিয়ে সে তার স্বামীকে আবৃত করতে চায়। স্বামীকে উপলক্ষ করে আপনাকে সে দান করছে তার দেবতাকে। দেবত র্তার পূজাকে বড়ো কঠিন করেছেন, এ প্রতিমা স্বচ্ছ নয়, কিন্তু এই তো ভক্তির পরীক্ষা । শালগ্রামশিলা তো কিছুই দেখায় না, ভক্তি সেই রূপহীনতার মধ্যে বৈকুণ্ঠনাথের রূপকে প্রকাশ করে কেবল আপন জোরে । যেখানে দেখা যাচ্ছে না সেইখানেই দেখব এই হোক আমার সাধনা, যেখানে ঠাকুর লুকিয়ে থাকেন সেইখানে গিয়েই তার চরণে আপনাকে দান করব, তিনি আমাকে এড়াতে পারবেন না। “মেরে গিরিধর গোপাল, ঔর নাহি কোহি”— দাদার কাছে শেখা মীরাবাইএর এই গানটা বারবার মনে-মনে আওড়াতে লাগল । মধুসূদনের অত্যন্ত রূঢ় যে পরিচয় সে পেয়েছে তাকে কিছুই নয় বলে জলের উপরকার বুদবুদ বলে উড়িয়ে দিতে চায়— চিরকালের যিনি সত্য, সমস্ত আবৃত করে তিনিই আছেন, “ঔর নাহি কোহি, ঔর নাহি কোহি ।” এ ছাড়া আর-একটা পীড়ন আছে তাকেও মায়া বলতে চায়— সে হচ্ছে জীবনের শূন্তত। আজ পর্যন্ত যাদের নিয়ে ওর সমস্ত কিছু গড়ে উঠেছে, যাদের বাদ দিতে গেলে জীবনের অর্থ থাকে না, তাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ– সে নিজেকে বলছে এই শূন্তও পূর্ণ— s “বাপে ছাড়ে, মায়ে ছাড়ে, ছাড়ে সগা সহী, মীরা প্রভু লগন লগী যো ন হোয়ে হোয়ী ।” ছেড়েছেন তো বাপ, ছেড়েছেন তো মা, কিন্তু তাদের ভিতরেই যিনি চিরকালকণর তিনি তো ছাড়েন নি। ঠাকুর আরও যা-কিছু ছাড়ান-না কেন, শূন্য ভরাবেন