পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२éb” রবীন্দ্র-রচনাবলী কিছুক্ষণ পরে থালা থেকে মুখ না তুলেই জিজ্ঞাসা করলে, “বড়োবউ এখন কোথায় ?” শু্যামাসুন্দরী ব্যস্ত হয়ে উঠল, “আমি দেখে আসছি।” মধুসূদন ভ্ৰকুঞ্চিত করে আঙল নেড়ে নিষেধ করলে। প্রশ্নের যে উত্তর পাবার আশা আছে সেটা এর মুখে শুনলে সহ হবে না— অথচ মনের মধ্যে যথেষ্ট কৌতুহল। আহার-শেষে তেতলায় যখন তার শোবার ঘরে গেল, মনের কোণে একটা ক্ষীণ প্রত্যাশা ছিল। একবার ছাদ এল ঘুরে। পাশের নাবার ঘরে ঢুকে ক্ষণকালের জন্যে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইল। তার পরে বিছানায় শুয়ে গুড়গুড়িতে টান দিতে লাগল। নির্দিষ্ট পনেরো মিনিট যায়— বিশ মিনিট পার হয়ে যখন আধঘণ্টা পুরো হতে চলল তখন বুকের পকেট থেকে ঘড়ি বের করে একবার সময়টা দেখলে। বৎসরের পর বৎসর গেছে, আপিসে যাবার পূর্বে কখনও পাচ মিনিট দেরি হয় নি। আপিসে একটা রেজিস্টারি বই আছে, কে ঠিক কোন সময়ে এল এবং গেল সেই বইয়ে তার . হিসাব থাকে— সেই হিসাবের সঙ্গে সঙ্গে বেতনের মাত্রারেখা ওঠানামা করে। আপিসের সকল কর্মচারীদের মধ্যে মধুসূদনের জরিমানার অঙ্ক সবচেয়ে সংখ্যায় কম। অথচ এ সম্বন্ধে নিজের প্রতি তার পক্ষপাত নেই। বস্তুত নিজের কাছ থেকে কর্মচারীদের চেয়ে ডবল হারে জরিমানা আদায় করে । মনে মনে আজ সে পণ করেছে যে, অপরাহ্লে আপিসের সময় উত্তীর্ণ হলে অতিরিক্ত সময় কাজ করে ক্ষতিপূরণ করে নেবে। বেলা যতই পড়ে আসছে, কাজে মন দিতে আর পারে না। এমনকি আজ আধঘণ্টা সময় থাকতেই কাজ ফেলে বাড়ি ফিরে এল। কেবলই ইচ্ছে করছিল অসময়ে একবার শোবার ঘরে এসে ঢুকতে। হয়তে কাউকে দেখতে পেতেও পারে। দিন থাকতে সে কখনোই শোবার ঘরে আসে না। আজ আপিসের সাজমৃদ্ধ অন্তঃপুরে প্রবেশ করলে। ঠিক সেই সময়ে মোতির মা ছাদের রোদরে-মেলা আমসিগুলো ঝুড়িতে তুলছিল। মধুসূদনকে অবেলায় শোবার ঘরে ঢুকতে দেখে একহাত ঘোমটা টেনে তার আড়ালে অনেকখানি হাসলে। মেজোবউয়ের কাছে তার এই অনিয়ম ধরা পড়াতে মধুসূদন লজ্জিত ও বিরক্ত হল। মনে প্ল্যান ছিল অত্যন্ত নিঃশবপদে ঘরে ঢুকবে— পাছে ভীরু হরিণী চকিত হয়ে পালায়। সে আর হল না। কৌতুকদৃষ্টির আঘাত এড়াবার জন্যে সে নিজেই দ্রুত ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলে। দেখলে আপিস-পালানো সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ঘরে কেউ তো নেই-ই, দিনের বেলা কোনোসময়ে কেউ যে ক্ষণকালের জন্যেও ছিল তার চিহ্নও পাওয়া যায় না। এক মুহূর্তে তার অধৈর্য যেন অসহ্য হয়ে