পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৬২ রবীন্দ্র-রচনাবলী পর্যন্ত তার দ্বারা হয় নি। তাই অগত্য বুড়ে বন্ধু ফরাশকে সহযোগিতার জন্যে ডাকবার প্রস্তাব তুললে। হার মানতে হল। বন্ধু ফরাশ এল, এবং দ্রুতহস্তে অল্পকালের মধ্যেই কাজ সমাধা করে দিলে। সন্ধ্যার পূর্বেই দীপগুলো ঘরে ঘরে ভাগ করে দিয়ে আসতে হয়। সেই কাজের জন্যে পূর্বনিয়মমত তাকে যথাসময়ে আসতে হবে কি না বন্ধু জিজ্ঞাসা করলে। লোকটা সরল প্রকৃতির বটে কিন্তু তবু প্রশ্নের মধ্যে একটু শ্লেষ ছিল-বা। কুমুর কানের ডগা লাল হয়ে উঠল। সে কোনো জবাব করবার আগেই মোতির মা বললে, “আসবি না তো কী ?” কুমুর বুঝতে একটুও বাকি রইল না যে, কাজ করতে গিয়ে কেবল সে কাজের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। צס\ দুপুরবেলা আহারের পর দরজা বন্ধ করে কুমু বসে পণ করতে লাগল, মনের মধ্যে কিছুতে সে ক্রোধের আগুন জলে উঠতে দেবে না। কুমু বললে, ‘আজকের দিনটা লাগবে মনকে স্থির করে নিতে ; ঠাকুরের আশীৰ্বাদ নিয়ে কাল সকাল থেকে সংসারধর্মের সত্যপথে প্রবৃত্ত হব। মধ্যাহ্নে আহারের পর তার কাঠের ঘরে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে চলল নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া। এই কাজে সবচেয়ে সহায় ছিল তার দাদার স্মৃতি । সে যে দেখেছে তার দাদার ধৈর্যের আশ্চর্য গভীরতা ; র্তার মুখে সেই বিষাদ, যেটি তার অস্তরের মহত্বের ছায়া— তার সেই দাদা, তখনকার কালে শিক্ষিতসমাজে প্রচলিত পজিটিভিজম যার ধর্ম ছিল, দেবতাকে বাইরে থেকে প্রণাম করা যার অভ্যাস ছিল না, অথচ দেবতা আপনিই যার জীবন পূর্ণ করে আবিৰ্ভত। অপরাহ্লে বস্তু ফরাশ যখন দরজায় আঘাত করলে, ঘর খুলে কুমু বেরিয়ে গেল । মোতির মাকে বললে, আজ রাত্রে সে খাবে না । মনকে বিশুদ্ধ করে নেবার জন্যেই তার এই উপবাস। মোতির মা কুমুর মুখ দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। সে মুখে আজ চিত্তজালার রক্তচ্ছটা ছিল না। ললাটে চক্ষুতে ছিল প্রশাস্ত স্নিগ্ধ দীপ্তি। এখনই যেন সে পূজা সেরে তীর্থস্নান করে এল। অন্তর্যামী দেবতা যেন তার সব অভিমান হরণ করে নিলেন ; হৃদয়ের মাঝখানে যেন সে এনেছে নির্মাল্যের ফুল বহন করে, তারই সুগন্ধ রয়েছে তাকে ঘিরে। তাই কুমু যখন উপবাসী থাকতে চাইলে তখন