পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ২৬৩ মোতির মা বুঝলে, এ অভিমানের আত্মপীড়ন নয়। তাই সে আপত্তিমাত্র করলে व्षी । কুমু তার ঠাকুরের মূর্তিকে অস্তরের মধ্যে বসিয়ে ছাদের এক কোণে গিয়ে আসন নিল। আজ সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে, দুঃখ যদি তাকে এমন করে ধাক্কা না দিত তা হলে সে অাপন দেবতার এত কাছে কখনোই আসতে পারত না । অস্তসূর্যের আভার দিকে তাকিয়ে কুমু হাত জোড় করে বললে, “ঠাকুর, আর কখনও যেন তোমার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ না ঘটে ; তুমি আমাকে কাদিয়ে তোমার আপন করে রাখো ।” শীতের দিন দেখতে দেখতে স্নান হয়ে এল। ধূলি কুয়াশা ও কলের ধেশয়াতে মিশ্রিত একটা বিবর্ণ আবরণে সন্ধ্যার স্বচ্ছ তিমির-গম্ভীর মহিমা আচ্ছন্ন। ওই আকাশটা যেমন একটা পরিব্যাপ্ত মলিনতার বোঝা নিয়ে মাটির দিকে নেমে পড়েছে, , তেমনি দাদার জন্যে একটা দুশ্চিন্তার দুঃসহ ভার কুমুর মনটাকে যেন নীচের দিকে নামিয়ে ধরে রেখে দিলে । এমনি করে এক দিকে কুমু অভিমানের বন্ধন থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে মুক্তির আনন্দ আর-এক দিকে দাদার জন্যে ভাবনায় পীড়িত হৃদয়ের ভার, দুইই একসঙ্গে নিয়ে আবার তার সেই কোটরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল । বড়ো ইচ্ছা, এই নিরুপায় ভাবনার বোঝাটাকেও একান্ত বিশ্বাসে ভগবানের উপর সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দেয়। কিন্তু নিজেকে বার বার ধিক্কার দিয়েও কিছুতেই সেই নির্ভর পায় না। টেলিগ্রাফ তো করা হয়েছে, তার উত্তর আসে না কেন, এই প্রশ্ন অনবরত মনে লেগেই রইল । নারীহৃদয়ের আত্মসমর্পণের সূক্ষ্ম বাধায় মধুসূদন কোথাও হাত লাগাতে পারছে ন। যে বিবাহিত স্ত্রীর দেহমনের উপর তার সম্পূর্ণ দাবি সেও তার পক্ষে নিরতিশয় দুর্গম। ভাগ্যের এমন অভাবনীয় চক্রাস্তকে সে কোন দিক থেকে কেমন করে আক্রমণ করবে ভেবে পায় না। কখনও কোনো কারণেই মধুসূদন নিজের ব্যাবসার প্রতি লেশমাত্র অমনোযোগী হয় নি, এখন সেই দুলক্ষণও দেখা দিল । নিজের মার পীড়া ও মৃত্যুতেও মধুসূদনের কর্মে কিছুমাত্র ব্যাঘাত ঘটে নি এ কথা সকলেই জানে। তখন তার অবিচলিত দৃঢ়চিত্ততায় অনেকে তাকে ভক্তি করেছে। মধুসুদন আজ হঠাৎ নিজের একটা নূতন পরিচয় পেয়ে নিজে স্তম্ভিত হয়ে গেছে, বাধা-পথের বাইরে যে শক্তি তাকে এমন করে টানছে সে যে তাকে কোন দিকে নিয়ে যাবে ভেবে পাচ্ছে न्मतः । রাত্রের আহার সেরে মধুসূদন ঘরে শুতে এল। যদিও বিশ্বাস করে নি, তবু আশ।