পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२१० রবীন্দ্র-রচনাবলী যতক্ষণ র্তার স্পর্শকে অনুভব করি ততক্ষণ এ দেহ কিছুতেই অপবিত্র হতে পারে না । এই কথা মনে করতে করতে আনন্দে তার চোখের পাতা ভিজে এল— তার দেহটা যেন মুক্তি পেলে মাংসের স্কুল বন্ধন থেকে। পুণ্যসম্মিলনের নিত্যক্ষেত্র বলে আপন দেহের উপর তার যেন ভক্তি এল। যদি কুন্দকুলের মালা হাতের কাছে পেত তা হলে এখনই আজ সে পরত গলায়, বাধত কবরীতে। স্নান করে পরল সে একটি শুভ্র শাড়ি, খুব মোটা লাল পাড় দেওয়া। ছাদে যখন বসল তখন মনে হল সূর্যের আলে৷ হয়ে আকাশপূর্ণ একটি পরম স্পর্শ তার দেহকে অভিনন্দিত করলে। মোতির মার কাছে এসে কুমু বললে, “আমাকে তোমার কাজে লাগিয়ে দাও।” মোতির মা হেসে বললে, “এসে তবে তরকারি কুটবে।” মস্ত মস্ত বারকোশ, বড়ো বড়ো পিতলের খোরা, ঝুড়ি ঝুড়ি শাকসবজি, দশপনেরোটা বঁটি পাতা— আত্মীয়া-অণত্রিতার গল্প করতে করতে দ্রুত হাত চালিয়ে যাচ্ছে, ক্ষতবিক্ষত খণ্ডবিখণ্ডিত তরকারিগুলো স্তৃপাকার হয়ে উঠছে। তারই মধ্যে কুমু এক জায়গায় বসে গেল। সামনে গরাদের ভিতর দিয়ে দেখা যায় পাশের বসতির এক বৃদ্ধ তেঁতুল গাছ তার চিরচঞ্চল পাতাগুলো দিয়ে স্বর্যের আলো চূর্ণ চূর্ণ করে ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে । মোতির মা মাঝে মাঝে কুমুর মুখের দিকে চেয়ে দেখে আর ভাবে, ও কি কাজ করছে, ন, ওর আঙলের গতি আশ্রয় করে ওর মন চলে যাচ্ছে কোন এক তীর্থের পথে ? ওকে দেখে মনে হয় যেন পালের নৌকে, আকাশে-তোলা পালটাতে হাওয়া এসে লাগছে, নৌকোটা যেন সেই স্পর্শেই ভোর, আর তার খোলের দু ধারে যে জল কেটে কেটে পড়ছে সেটা যেন খেয়ালের মধ্যেই নেই। ঘরে অন্য যারা কাজ করছে তারা যে কুমুর সঙ্গে গল্পগুজব করবে এমন যেন একটা সহজ রাস্ত পাচ্ছে না। শু্যামাসুন্দরী একবার বললে, “বউ, সকালেই যদি স্নান কর, গরম জল বলে দাও ন৷ কেন ? ঠাও লাগবে না তো ?” কুমু বললে, “আমার অভ্যেস আছে।” আলাপ আর এগোল না। কুমুর মনের মধ্যে তখন একটা নীরব জপের ধারা চলছে— পিতেব পুত্রস্ত সখেব সখু:ি প্রিয় প্রিয়ায়াৰ্হসি দেব সোঢ়ম তরকারি-কেটা ভাড়ার-দেওয়ার কাজ শেষ হয়ে গেল, মেয়ের স্বানের জন্যে অন্দরের উঠোনে কলতলায় গিয়ে কলরব তুললে।