পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२१२ রবীন্দ্র-রচনাবলী করতে হবে । তার সঙ্গে লড়াই করতে চাইলে সব সময় তো তার নাগাল পাওয়া যায় না। গুহার মধ্যে সে দুর্গ তৈরি করে থাকে, বাইরে থেকে সেখানে প্রবেশের পথ কই ? তাই এমন একটি প্রেমের বন্যা নামিয়ে আন চাই যাতে রুদ্ধকে মুক্ত করে, বদ্ধকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অনেক ভুলিয়ে দেবার ওর একটি উপায় হাতে ছিল, সে হচ্ছে সংগীত। কিন্তু এ বাড়িতে এসরাজ বাজাতে ওর লজ্জ করে। সঙ্গে এসরাজ আনেও নি। কুমু গান গাইতে পারে, কিন্তু কুমুর গলায় তেমন জোর নেই। গানের ধারায় আকাশ ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছা করল, অভিমানের গান। যে গানে ও বলতে পারে, “আমি তো তোমারই ডাকে এসেছি, তবে তুমি কেন লুকোলে ? আমি তো নিমেষের জন্যে দ্বিধা করি নি, তবে আজ আমাকে কেন এমন সংশয়ের মধ্যে ফেললে ?” এই-সব কথা খুব গলা ছেড়ে গান গেয়ে ওর বলতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, তা হলেই যেন স্বরে এর উত্তর পাবে। \O8 কুমুর পালাবার একটিমাত্র জায়গা আছে, এ বাড়ির ছাদ। সেইখানে চলে গেল । বেলা হয়েছে, প্রখর রৌদ্রে ছাদ ভরে গেছে, কেবল প্রাচীরের গায়ে এক জায়গায় একটুখানি ছায়া। সেইখানে গিয়ে বসল। একটি গান মনে পড়ল, তার স্বরটি আসাবরী। সে গানের আরম্ভটি হচ্ছে, ‘বশিরী হমারি রে’— কিন্তু বাকিটুকু ওস্তাদের মুখে মুখে বিকৃত বাণী— তার মানে বুঝতে পারা যায় না। কুমু ওই অসম্পূর্ণ অংশ আপন ইচ্ছামত নূতন নূতন তান দিয়ে ভরিয়ে পালটে পালটে গাইতে লাগল। ওই একটুখানি কথা অর্থে ভরে উঠল । ওই বাক্যটি যেন বলছে, ‘ও আমার বঁাশি, তোমাতে স্থর ভরে উঠছে না কেন ? অন্ধকার পেরিয়ে পেীচচ্ছে না কেন যেখানে দুয়ার রুদ্ধ, যেখানে ঘুম ভাঙল না ? বঁাশরা হমারি রে, বাশরী হমারি রে! মোতির মা যখন এসে বললে "চলো ভাই, খেতে যাবে” তখন সেই ছাদের কোণের একটুখানি ছায়া গেছে লুপ্ত হয়ে, কিন্তু তখন ওর মন স্বরে ভরপুর, সংসারে কে ওর পরে কী অন্যায় করেছে সে সমস্ত তুচ্ছ হয়ে গেছে। ওর চিঠি নিয়ে মধুসূদনের যে ক্ষুদ্রতা, যে ক্ষুদ্রতায় ওর মনে তীব্র অবজ্ঞা উদ্যত হয়ে উঠেছিল, সে যেন এই রোদভরা আকাশে একটা পতঙ্গের মতো কোথায় বিলীন হয়ে গেল, তার ক্রুদ্ধ গুঞ্জন মিলিয়ে গেল অসীম আকাশে। কিন্তু চিঠির মধ্যে দাদার যে স্নেহবাক্য আছে সেটুকু পাবার জন্তে তার মনের আগ্রহ তো যায় না।