পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

११8 রবীন্দ্র-রচনাবলী কুমু একটুখানি চুপ করে রইল, মনকে শাস্ত করে তার পরে বললে, “এ চিঠি তুমি আমাকে পড়তে দিতে ইচ্ছে কর নি, সেইজন্যে এ চিঠি আমি পড়ব না। এই আমি ছিড়ে ফেললুম। কিন্তু এমন কষ্ট আমাকে আর কখনও দিয়ে না। এর চেয়ে কষ্ট আমার আর কিছু হতে পারে না।” ' to এই বলে সে মুখে কাপড় দিয়ে ছুটে বেরিয়ে চলে গেল । ইতিপূর্বে আজ মধ্যাহ্নে আহারের পর মধুসূদনের মনটা আলোড়িত হয়ে উঠছিল। আন্দোলন কিছুতে থামাতে পারছিল না। কুমুর খাওয়া হলেই তাকে ডাকিয়ে পাঠাবে বলে ঠিক করে রেখেছে। আজ সে মাথার চুল আঁচড়ানো সম্বন্ধে একটু বিশেষ যত্ব নিলে। আজ সকালেই একটি ইংরেজ নাপিতের দোকান থেকে স্পিরিট-মেশানে সুগন্ধি কেশতৈল ও দামি এসেন্স কিনিয়ে আনিয়েছিল। জীবনে এই প্রথম সেগুলি সে ব্যবহার করেছে। সুগন্ধি ও সুসজ্জিত হয়ে সে প্রস্তুত ছিল। আপিসের সময় আজ অন্তত পয়তাল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেল । ↔ সিড়িতে পায়ের শব্দ পেতেই মধুসূদন চমকে উঠে বসল। হাতের কাছে আরকিছু না পেয়ে একখানা পুরোনো খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের পাতাটা নিয়ে এমনভাবে সেটাকে দেখতে লাগল যেন তার আপিসেরই কাজের অঙ্গ। এমন-কি পকেট থেকে একটা মোটা নীল পেন্সিল বের করে দুটো-একটা দাগও টেনে দিলে। এমন সময়ে ঘরে প্রবেশ করলে স্যামামুন্দরী। ভ্ৰকুঞ্চিত করে মধুসুদন তার মুখের দিকে চাইলে। খামাম্বন্দরী বললে, “তুমি এখানে বসে আছ ; বউ যে তোমাকে খুজে বেড়াচ্ছে।” “খুজে বেড়াচ্ছে! কোথায় ?” “এই যে দেখলুম, বাইরে তোমার আপিসঘরে গিয়ে ঢুকল। তা এতে অত আশ্চর্য হচ্ছ কেন ঠাকুরপো— সে ভেবেছে তুমি বুঝি—” তাড়াতাড়ি মধুসূদন বাইরে চলে গেল। তার পরেই সেই চিঠির ব্যাপার। পালের নৌকায় হঠাৎ পাল ফেটে গেলে তার যে দশা মধুসূদনের তাই হল। তখন আর দেরি করবার লেশমাত্র অবকাশ ছিল না। আপিলে চলে গেল। কিন্তু সকল কাজের ভিতরে ভিতরে তার অসম্পূর্ণ ভাঙা চিন্তার তীক্ষ ধারগুলো কেবলই যেন ঠেলে ঠেলে বিধে বিধে উঠছে। এই মানসিক ভূমিকম্পের মধ্যে মনোযোগ দিয়ে কাজ করা সেদিন তার পক্ষে একেবারে অসম্ভব । অাপিসে জানিয়ে দিলে উৎকট মাথা ধরেছে, কার্যশেষের অনেক আগেই বাড়ি ফিরে এল।