পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ミbペ রবীন্দ্র-রচনাবলী ভয়ে ভয়ে বাড়িতে এল, অস্তে আস্তে আহার করলে। আহার করে তখনই সাহস হল না শোবার ঘরে যেতে। প্রথমে কিছুক্ষণ বাইরের দক্ষিণের বারান্দায় পায়চারি করে বেড়াতে লাগল। শোবার সময় নটা যখন বাজল তখন গেল অন্তঃপুরে। আজ ছিল দৃঢ় পণ— যথাসময়ে বিছানায় শোবে, কিছুতেই অন্যথা হবে না। শূন্ত শোবার ঘরে ঢুকেই মশারি খুলেই একেবারে ঝপ করে বিছানার উপরে পড়ল। ঘুম আসতে চায় না। রাত্রি যতই নিবিড় হয় ততই ভিতরকার উপবাসী জীবট অন্ধকারে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। তখন তাকে তাড়া করবার কেউ নেই, পাহারাওআলার সকলেই ক্লাস্ত । s ঘড়িতে একটা বাজল, চোখে একটুও ঘুম নেই ; আর থাকতে পারল না, বিছানা থেকে উঠে ভাবতে লাগল কুমু কোথায় ? বন্ধু ফরাশের উপর কড়া হুকুম, ফরাশখান। তালাচাবি দিয়ে বন্ধ। ছাদ ঘুরে এল, কেউ নেই। পায়ের জুতো খুলে ফেলে নীচের তলায় বারান্দা বেয়ে ধীরে ধীরে চলতে লাগল। মোতির মার ঘরের সামনে এসে মনে হল যেন কথাবার্তার শব্দ হতে পারে, কাল চলে যাবে, আজি স্বামীীতে পরামর্শ চলছে। বাইরে চুপ করে দরজায় কান পেতে রইল। দুজনে গুন গুন করে আলাপ চলছে। কথা শোনা যায় না, কিন্তু স্পষ্টই বোঝা গেল দুটিই মেয়ের গল। তবে তো বিচ্ছেদের পূর্বরাত্রে মোতির মায়ের সঙ্গে কুমুরই মনের কথা হচ্ছে । রাগে ক্ষোভে ইচ্ছে করতে লাগল লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলে একটা কণও করে। কিন্তু নবীনটা তা হলে কোথায় ? নিশ্চয় বাইরে। অন্তঃপুর থেকে বাইরে যাবার ঝিলমিল-দেওয়া রাস্তাটাতে লণ্ঠনে একটা টিমটিমে আলো জলছে, সেইখানে এসেই মধুসূদন দেখলে একখান লাল শাল গায়ে জড়িয়ে খাম দাড়িয়ে। তার কাছে লজ্জিত হয়ে মধুসূদন রেগে উঠল। বললে, “কী করছ এত রাত্রে এখানে ?” খাম। উত্তর করলে, “শুয়েছিলুম। বাইরে পায়ের শব্দ শুনে ভয় হল, ভাবলুম বুঝি—” মধুসূদন তর্জন করে বলে উঠল, "আস্পর্ধা বাড়ছে দেখছি। আমার সঙ্গে চালাকি করতে চেয়ে না, সাবধান করে দিচ্ছি। যাও শুতে।” খামান্বন্দরী কয়দিন থেকে একটু একটু করে তার সাহসের ক্ষেত্র বাড়িয়ে বাড়িয়ে চলছিল। আজ বুঝলে, অসময়ে অজায়গায় পা পড়েছে। অত্যন্ত করুণ মুখ করে একবার সে মধুসূদনের দিকে চাইলে, তার পরে মুখ ফিরিয়ে আঁচলট টেনে চোখ মুছলে। চলে যাবার উপক্রম করে আবার সে পিছন ফিরে দাড়িয়ে বলে উঠল, “চালাকি করব না ঠাকুরপো। যা দেখতে পাচ্ছি তাতে চোখে ঘুম আসে না।