পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 疊 २br> কুমুদিনী ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, “ছি ছি অমন করে বোলে না।” মাটিতে পড়ে মধুসূদনের পায়ের ধুলো নিয়ে বললে, “আমি তোমার দাসী, আমাকে তুমি আদেশ করে৷ ” মধুস্থান তাকে হাত ধরে তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরলে, বললে, “ন, তোমাকে আদেশ করব না, তুমি আপন ইচ্ছাতে আমার কাছে এসো।” । কুমুদিনী মধুসূদনের বাহুবন্ধনে ইপিয়ে উঠল। কিন্তু নিজেকে ছাড়াবার চেষ্ট৷ করলে না। মধুসূদন রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বললে, “না, তোমাকে আদেশ করব না, তবু তুমি আমার কাছে এসো।” এই বলে কুমুদিনীকে ছেড়ে দিলে। কুমুদিনীর গৌরবর্ণ মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে চোখ নিচু করে বললে, “তুমি আদেশ করলে আমার কর্তব্য সহজ হয়। আমি নিজে ভেবে কিছু করতে পারি নে।” “আচ্ছা, তুমি তোমার ওই গায়ের চাদরখানা খুলে ফেলো— ওটাকে আমি দেখতে পারছি নে।” pi সসংকোচে কুমুদিনী চাদরখানা খুলে ফেললে। গায়ে ছিল একখানি ডুরে শাড়ি, সরু পাড়ের। কালো ডোরার ধারাগুলি কুমুদিনীর তমুদেহটিকে ঘিরে, যেন তারা রেখার ঝরনা— থেমে আছে মনে হয় না, কেবলই যেন চলছে— যেন কোনো একটি কালো দৃষ্টি আপন অশ্রান্ত গতির চিহ্ন রেখে রেখে ওর অঙ্গকে ঘিরে ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে, কিছুতে শেষ করতে পারছে না। মুগ্ধ হয়ে গেল মধুসূদন, অথচ সেই মুহূর্তে একটু লক্ষ্য না করে থাকতে পারলে না যে, ওই শাড়িটি এখানকার দেওয়া নয়। কুমুদিনীকে যতই মানাক না কেন, এর দাম তুচ্ছ এবং এটা ওর বাপের বাড়ির। ওই নাবার ঘরের সংলগ্ন কাপড় ছাড়বার ঘরে অাছে দেরাজওআল। মেহগিনি কাঠের মস্ত আলমারি, তার আয়না-দেওয়া পাল্লা— বিবাহের পূর্ব হতেই নানা রকমের দামি কাপড়ে ঠাসা । সেগুলির উপরে লোভ নেই– মেয়ের এত গর্ব ! মনে পড়ে গেল সেই তিনটে আংটির কথা, অসহ ঔদাসীন্যে তাকে কুমু গ্রহণ করে নি, অথচ একটা লক্ষ্মীছাড়া নীলার আংটির জন্যে কত আগ্রহ! বিপ্রদাস আর মধুসূদনের মধ্যে কুমুর মমতার কত মূল্যভেদ । চাদর খোলবামাত্র এই-সমস্ত কথা দমকা ঝড়ের মতে মধুসূদনকে প্রকাও ধাক্কা দিলে। কিন্তু হয় রে, কী সুন্দর, কী আশ্চর্য সুন্দর । আর এই দৃপ্ত অবজ্ঞ, সেও যেন ওর অলংকার। এই মেয়েই তো পারে ঐশ্বৰ্ষকে অবজ্ঞা করতে। সহজ সম্পদে মহীয়সী হয়ে জন্মেছে— ওকে ধনের দাম কষতে হয় না, হিসেব রাখতে হয় না— মধুসূদন ওকে কী দিয়ে লোভ দেখাতে পারে! মধুসূদন বললে, “যাও, তুমি শুতে যাও।”