পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ २3»S যখন অকারণ মারে তখন সে যেমন কিছুই বুঝতে পারে না, অভিমান করে আঘাত গায়ে পেতে নেয়, প্রতিবাদ করবারও চেষ্টা করতে মুখে বাধে, ঠাকুরের পরে কুমুর আজ সেইরকম ভাব। যে আহবানকে সে দৈব বলে মেনেছিল, সে কি এই অশুচিতার মধ্যে, এই আস্তরিক অসতীত্বে ? ঠাকুর নারীবলি চান বলেই শিকার ভুলিয়ে এনেছেন নাকি ; যে শরীরটার মধ্যে মন নেই সেই মাংসপিণ্ডকে করবেন তার নৈবেদ্য ? আজি কিছুতে ভক্তি জাগল না। এতদিন কুমুবার বার করে বলেছে, আমাকে তুমি সহ করো— আজ বিদ্রোহিণীর মন বলছে, তোমাকে আমি সহ করব কী করে ? কোন লজ্জায় আনব তোমার পূজা ? তোমার ভক্তকে নিজে না গ্রহণ করে তাকে বিক্রি করে দিলে কোন দাসীর হাটে— যে হাটে মাছমাংসের দরে মেয়ে বিক্রি হয়, যেখানে নির্মাল্য নেবার জন্যে কেউ শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজার অপেক্ষা করে না, ছাগলকে দিয়ে ফুলের বন মুড়িয়ে খাইয়ে দেয়। মোতির মা যখন দুধ খাবার জন্যে অনুরোধ করলে, কুমু বললে, “থাক।” মোতির মা বললে, “কেন, থাকবে কেন ? আমার দুধের বাটির অপরাধ কী ?” কুমু বললে, “এখনও স্নান করি নি, পূজা করি নি।” মোতির মা বললে, “যাও তুমি স্নান করতে, আমি অপেক্ষা করে থাকব।” কুমু স্নান সেরে এল। মোতির মা ভাবলে এইবার সে খোলা ছাদের কোণটাতে গিয়ে বসবে। কুমু মুহূর্তের জন্যে অভ্যাসের টানে ছাদের দিকে যেতে পা বাড়িয়েছিল, গেল না, ফিরে আবার সেই মাটিতে এসে বসল। তার মন তৈরি ছিল না। মোতির মাকে কুমু জিজ্ঞাসা করলে, “দাদার চিঠি কি আসে নি ?” চিঠি খুব সম্ভব এসেছে মনে করেই আজ খুব ভোরে মোতির মা নিজে লুকিয়ে আপিসঘরে গিয়ে চিঠির দেরাজটা টানতে নিয়ে দেখলে সেটা চাবি দিয়ে বন্ধ। অতএব এখন থেকে চুরির উপর বাটপাড়ি করবার রাস্ত আটক রইল। মোতির মা বললে, “ঠিক বলতে তো পারি নে, খবর নিয়ে দেখব।” এমন সময় হঠাৎ শু্যামা এসে উপস্থিত ; বললে, “বউ, তোমাকে এমন শুকনো দেখি যে, অসুখ করে নি তো ?” কুমু বললে, “না।” “বাড়ির জন্যে মনটা কেমন করছে । আহা, তা তো হতেই পারে। তা তোমার দাদা তো আসছেন, দেখা হবে।” কুমু চমকে উঠে শুমার মুখের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চাইলে। মোতির মা জিজ্ঞাসা করলে, “এ খবর তুমি কোথায় পেলে বকুলফুল ?”