পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ \59 מס এমনতরো মুশকিলের প্রশ্ন কেন জিজ্ঞাসা করা ? কুমু চুপ করে এসরাজের ছড়িটা নাড়াচাড়া করতে লাগল। “বুঝেছি, দরখাস্ত নামঞ্জুর।” কুমু কথাটা ঠিক বুঝলে না। মধুসুদন বললে, “তোমার বুকের কাছে আমার অন্তরের এই দরখাস্তটি লটকিয়ে দেব ইচ্ছে ছিল— কিন্তু তার অাগেই ডিসমিস।” কুমুর সামনে মেজের উপর গয়নাটা রইল খোলা। দুজনে কেউ একটিও কথা বললে না। থেকে থেকে কুমু যেরকম স্বপ্নবিষ্ট হয়ে যায়, তেমনি হয়ে রইল। একটু পরে যেন সচেতন হয়ে মালাটা তুলে নিয়ে গলায় পরলে, আর মধুসুদনকে প্রণাম করলে। বললে, “তুমি আমার বাজনা শুনবে ?” মধুসুদন বললে, “ই শুনব।” • “এখনই শোনাব’ বলে এসরাজের স্বর বাধলে । কেদারায় আলাপ আরম্ভ করলে ; ভুলে গেল ঘরে কেউ আছে, কেদারা থেকে পৌঁছোল ছায়ানটে। যে গানটি সে ভালোবাসে সেইটি ধরল, ‘ঠাড়ি রহো মেরে অঁাখনকে আগে।” স্বরের আকাশে রঙিন ছায়া ফেলে এল সেই অপরূপ আবির্ভাব, যাকে কুমু গানে পেয়েছে, প্রাণে পেয়েছে, কেবল চোখে পাবার তৃষ্ণ নিয়ে যার জন্যে মিনতি চিরদিন রয়ে গেল— ‘ঠাড়ি রহো মেরে অঁাখনকে আগে।’ মধুসূদন সংগীতের রস বোঝে না, কিন্তু কুমুর বিশ্ববিস্মৃত মুখের উপর যে স্বর খেলছিল, এসরাজের পর্দায় পর্দায় কুমুর আঙ ল-ছোয়ার যে ছন্দ নেচে উঠছিল তাই তার বুকে দোল দিলে, মনে হতে লাগল ওকে যেন কে বরদান করছে। আনমনে বাজাতে বাজাতে কুমু হঠাৎ একসময়ে দেখতে পেলে মধুসুদন তার মুখের উপর একদৃষ্টি চেয়ে, অমনি হাত গেল থেমে, লজ্জ এল, বাজনা বন্ধ করে দিলে। মধুসূদনের মন দাক্ষিণ্যে উদ্বেল হয়ে উঠল, বললে, “বড়োবউ, তুমি কী চাও বলে।” কুমু যদি বলত, কিছুদিন দাদার সেবা করতে চাই, মধুসূদন তাতেও রাজি হতে পারত ; কেননা আজ কুমুর গীতমুগ্ধ মুখের দিকে কেবলই চেয়ে চেয়ে সে নিজেকে বলছিল, ‘এই তো আমার ঘরে এসেছে, এ কী আশ্চর্য সত্য !’ কুমু এসরাজ মাটিতে রেখে, ছড়ি ফেলে চুপ করে রইল। মধুসুদন আর-একবার অনুনয় করে বললে, “বড়োবউ, তুমি আমার কাছে কিছু চাও। যা চাও তাই পাবে।” কুমু বললে, “মুরলী বেয়ারাকে একখানা শীতের কাপড় দিতে চাই।”