পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ○○○ মধুসুদন বাড়ি ফিরল অনেক রাত্রে, সঙ্গে একরাশ কাগজপত্রের বোঝা। নবীন উকি মেরে দেখলে, মধুসূদন শুতে না গিয়ে চোখে চশমা এটে নীল পেনসিল হাতে আপিসঘরের ডেস্কে কোনো দলিলে বা দাগ দিচ্ছে, নোটবইয়ে বা নোট নিচ্ছে। নবীন সাহস করে ঘরে ঢুকেই বললে, “দাদা, আমি কি তোমার কোনো কাজ করে দিতে পারি?” মধুসুদন সংক্ষেপে বললে, “না।” ব্যাবসার এই সংকটের অবস্থাটাকে মধুসুদন সম্পূর্ণ নিজে আয়ত্ত করে নিতে চায়, সবট। তার একার চোখে প্রত্যক্ষ হওয়া দরকার ; এ কাজে অন্যের দৃষ্টির সহায়তা নিতে গেলে নিজেকে দুর্বল করা হবে। নবীন কোনো কথা বলবার ছিদ্র না পেয়ে বেরিয়ে গেল। শীঘ্ৰ যে সুযোগ পাওয়া যাবে এমন তো ভাবে বোধ হল না। নবীনের পণ, কাল সকালেই বউরানীকে রওনা করে দেবে। আজ রাত্রেই সম্মতি আদায় করা চাই । খানিকক্ষণ বাদে নবীন একটা ল্যাম্প হাতে করে দাদার টেবিলের উপরে রেখে বললে, “তোমার আলো কম হচ্ছে।” মধুসূদন অনুভব করলে, এই দ্বিতীয় ল্যাম্পে তার কাজের অনেকখানি সুবিধা হল। কিন্তু এই উপলক্ষেও কোনো কথার স্বচনা হতে পারল না। আবার নবীনকে বেরিয়ে আসতে হল। একটু পরেই মধুসূদনের অভ্যস্ত গুড়গুড়িতে তামাক সেজে তার চৌকির বা পাশে বসিয়ে নলটা টেবিলের উপর আস্তে আস্তে তুলে রাখলে। মধুসুদন তখনই অনুভব করলে এটারও দরকার ছিল। ক্ষণকালের জন্যে পেনসিলটা রেখে তামাক টানতে লাগল। এই অবকাশে নবীন কথা পাড়লে, “দাদা, শুতে যাবে না ? অনেক রাত হয়েছে। বউরানী তোমার জন্তে হয়তো জেগে বসে আছেন।” ‘জেগে বসে আছেন কথাটা এক মুহূর্তে মধুসূদনের মনের ভিতরে গিয়ে লাগল। ঢেউয়ের উপর দিয়ে জাহাজ যখন টলমল করতে করতে চলেছে, একটি ছোটাে ডাঙার পাখি উড়ে এসে যেন মাস্তুলে বসল ; ক্ষুব্ধ সমুদ্রের ভিতর ক্ষণকালের জন্যে মনে এনে দিলে স্যামল দ্বীপের নিভৃত বনচ্ছায়ার ছবি । কিন্তু সে কথায় মন দেবার সময় নয়, জাহাজ চালাতে হবে। মধুসুদন আপন মনের এইটুকু চাঞ্চল্যে ভীত হল । তখনই সেটা দমন করে বললে, “বড়োবউকে শুতে যেতে বলে, আজ আমি বাইরে শোব।” "তাকে না হয় এখানে ডেকে দিই" বলে নবীন গুড়গুড়ির কলকেটাতে ফ, দিতে লাগল।