পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

©ዓ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রকাশে অবজ্ঞা দেখাতে পারলে তারা যেন বঁাচে এমনি অবস্থা। সেইজন্যেই শু্যাম৷ তাদেরকে যখন তখন অনাবশ্যক ভৎসনা ও অকারণে ফরমাশ ক’রে কেবলই তাদের দোষত্রুটি ধরে। খিটু খিটু করে। বাপ মা তুলে গাল দেয়। কিছুদিন পূর্বে এই বাড়িতেই খাম নগণ্য ছিল, সেই স্মৃতিটাকে সংসার থেকে মুছে ফেলবার জন্যে খুব কড়াভাবে মাজাঘষার কাজ করতে গিয়ে দেখে যে সেটা সয় না। বাড়ির একজন পুরোনো চাকর খামার তর্জন না সইতে পেরে কাজে ইস্তফা দিলে। তাই নিয়ে খামাকে মাথা হেঁট করতে হল। তার কারণ, নিজের ধনভাগ্য সম্বন্ধে মধুসূদনের কতকগুলো অন্ধ সংস্কার আছে। যে-সব চাকর তার আর্থিক উন্নতির সমকালবতী, তাদের মৃত্যু বা পদত্যাগকে ও দুলক্ষণ মনে করে। অনুরূপ কারণেই সেই সময়কার একটা মসীচিহ্নিত অত্যন্ত পুরোনো ডেস্ক অসংগতভাবে আপিসঘরে হলে আমলের দামি আসবাবের মাঝখানেই অসংকোচে প্রতিষ্ঠিত আছে, তার উপরে সেই সেদিনকারই দস্তার দোয়াত আর একটা সস্ত বিলিতি কাঠের কলম, যে কলমে সে, তার ব্যবসায়ের নবযুগে প্রথম বড়ো একটা দলিলে নাম সই করেছিল। সেই সময়কার উড়ে চাকর দধি যখন কাজে জবাব দিলে মধুসূদন সেটা গ্রাহাই করলে না, উলটে সে লোকটার ভাগ্যে বকশিশ জুটে গেল। স্যামাসুন্দরী এই নিয়ে ঘোরতর অভিমান করতে গিয়ে দেখে হালে পানি পায় না। দধির হাসিমুখ তাকে দেখতে হল। খামার মুশকিল এই মধুসুদনকে সে সত্যিই ভালোবাসে, তাই মধুসূদনের মেজাজের উপর বেশি চাপ দিতে ওর সাহস হয় না, সোহাগ কোন সীমায় স্পর্ধায় এসে পৌছোবে খুব ভয়ে ভয়ে তারই আন্দাজ করে চলে। মধুস্থদনও নিশ্চিত জানে শু্যামার সম্বন্ধে সময় বা ভাবনা নষ্ট করবার দরকার নেই। আদরআবদার-ঘটিত অপব্যয়ের পরিমাণ সংকোচ করলেও দুর্ঘটনার আশঙ্কা অল্প। অথচ শু্যামাকে নিয়ে ওর একটা স্থূল রকম মোহ আছে, কিন্তু সেই মোহকে ষোলো আন৷ ভোগে লাগিয়েও তাকে অনায়াসে সামলিয়ে চলতে পারে এই আনন্দে মধুসূদন উৎসাহ পায়— এর ব্যতিক্রম হলে বন্ধন ছিড়ে যেত। কর্মের চেয়ে মধুসূদনের কাছে বড়ো কিছু নেই। সেই কর্মের জন্তে ওর সবচেয়ে দরকার অবিচলিত আত্মকতৃত্ব । তারই সীমার মধ্যে খামার কতৃত্ব প্রবেশ করতে সাহস পায় না, অল্প একটু পা বাড়াতে গিয়ে উচোট খেয়ে ফিরে আসে। শু্যাম তাই কেবলই আপনাকে দানই করে, দাবি করতে গিয়ে ঠকে। টাকাকড়ি-সাজসরঞ্জামে শু্যাম চিরদিন বঞ্চিত— তার পরে ওর লোভের অস্ত নেই। এতেও তাকে পরিমাণ রক্ষা করে চলতে হয়। এতবড়ো ধনীর কাছে যা অনায়াসে প্রত্যাশা করতে পারত তাও ওর পক্ষে দুরাশা। মধুসূদন