পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য 8やQ কিন্তু সত্যকে সম্যক প্রতীয়মান করিয়া তুলিবার জন্য কিয়ৎপরিমাণে ভারের আবশ্বক, সেটুকু ভারে কেবল সত্য ভালোরূপ অনুভবগম্য হইয়া হৃদয়ের আনন্দ উৎপাদন করে ; কল্পনাজগৎ প্রত্যক্ষবং দৃঢ় স্পর্শযোগ্য ও চিরস্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত বোধ হয় । বঙ্কিমবাবু রাজসিংহে সেই আবশ্বক ভারেরও কিয়দংশ যেন বাদ দিয়াছেন বোধ হয়। ভারে যেটুকু কম পড়িয়াছে গতির দ্বারায় তাহ পূরণ করিয়াছেন। উপন্যাসের প্রত্যেক অংশ অসন্দিগ্ধরূপে সম্ভবপর ও প্রশ্নসহ করিয়া তুলেন নাই, কিন্তু সমস্তটার উপর দিয়া এমন দ্রুত অবলীলাভঙ্গীতে চলিয়া গিয়াছেন যে প্রশ্ন করিবার আবশ্বক হয় নাই। যেন রেলপথের মাঝে মাঝে এমন এক-আধটা ব্রিজ আছে যাহা পুরা মজবুত বলিয়া বোধ হয় না— কিন্তু চালক তাহার উপর দিয়া এমন দ্রুত গাড়ি লইয়া চলে যে, ব্রিজ ভাঙিয়া পড়িবার অবসর পায় না। এমন হইবার কারণও স্পষ্ট পড়িয়া রহিয়াছে। যখন বৃহৎ সৈন্যদল যুদ্ধ করিতে চলে তখন তাহারা সমস্ত ঘরকরন কাধে করিয়া লইয়া চলিতে পারে না। বিস্তর আবশ্যক দ্রব্যের মায়াও তাহাদিগকে ত্যাগ করিতে হয়। চলৎশক্তির বাধা তাহণদের পক্ষে মারাত্মক। গৃহস্থ-মানুষের পক্ষে উপকরণের প্রাচুর্য এবং ভারবাহুল্য শোভ পায় । রাজসিংহের গল্পটা সৈন্যদলের চলার মতো— ঘটনাগুল বিচিত্র বৃহ রচনা করিয়া বৃহৎ আকারে চলিয়াছে। এই সৈন্যদলের নায়ক যাহারা তাহারাও সমান বেগে চলিয়াছেন, নিজের সুখদুঃখের খাতিরে কোথাও বেশিক্ষণ থামিতে পারিতেছেন না । একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। রাজসিংহের সহিত চঞ্চলকুমারীর প্রণয়ব্যাপারট তেমন ঘনাইয় উঠে নাই বলিয়া কোনো কোনো পাঠক এবং সম্ভবত বহুসংখ্যক পাঠিক আক্ষেপ করিয়া থাকেন। বঙ্কিমবাৰু বড়ো-একটি দুর্লভ অবসর পাইয়াছিলেন– এই সুযোগে কন্দপের পঞ্চশরে এবং করুণরসের বরুণবাণে দিগ্‌বিদিক সমাকুল করিয়া তুলিতে পারিতেন। কিন্তু তাহার সময় ছিল না । ইতিহাসের সমস্ত প্রবাহ তখন একটি সংকীর্ণ সন্ধিপথে বজ্ৰস্তনিতরবে ফেনাইয়া চলিতেছে— তাহারই উপর দিয়া সামাল সামাল তরী। তখন রহিয়া-বসিয়া ইনিয়া-বিনিয়া প্রেমাভিনয় করিবার সময় নহে। তখনকার যে প্রেম, সে অত্যন্ত বাহুল্যবর্জিত সংক্ষিপ্ত সংহত । সে তো বাসররাত্রের মুখশয্যার বাসস্তী প্রেম নহে– ঘনবর্ষার কালরাত্রে মৃত্যু হঠাৎ পশ্চাৎ হইতে আসিয়া দোলা দিয়াছে – মান-অভিমান লাজ-লজ্জা বিসর্জন দিয়া ত্রস্ত