পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী سزاوا 8 এ গ্রন্থে প্রকাশ পায় নাই । জেবউন্নিসার সহিত ইতিহাসের যোগ অাছে বটে কিন্তু সে যোগ গৌণভাবে । সে যোগটুকু না থাকিলে এ গ্রন্থের মধ্যে তাহার কোনো অধিকার থাকিত না। যোগ আছে কিন্তু বিপুল ইতিহাস তাহাকে গ্রাস করিয়া আপনার অংশীভূত করিয়া লয় নাই, সে আপনার জীবন-কাহিনী লইয়। স্বতন্ত্রভাবে দীপ্যমান হইয়া উঠিয়াছে। সাধারণ ইতিহাসের একটা গৌরব অাছে। কিন্তু স্বতন্ত্র মানবজীবনের মহিমাও তদপেক্ষা নূ্যন নহে। ইতিহাসের উচ্চচূড় রথ চলিয়াছে, বিস্মিত হইয় দেখো, সমবেত হইয়া মাতিয়া উঠ, কিন্তু সেই রথচক্রতলে যদি একটি মানবহৃদয় পিষ্ট হইয়৷ ক্ৰন্দন করিয়া মরিয়া যায় তবে তাহার সেই মর্মান্তিক অার্তধ্বনিও, রথের চুড়া যে গগনতল স্পর্শ করিতে স্পর্ধা করিতেছে সেই গগনপথে উচ্ছসিত হইয় উঠে, হয়তো সেই রথচূড়া ছাড়াইয়া চলিয়া যায়। বঙ্কিমবাবু সেই ইতিহাস এবং মানব উভয়কেই একত্র করিয়া এই ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করিয়াছেন । তিনি এই বৃহৎ জাতীয়-ইতিহাসের এবং তীব্র মানব-ইতিহাসের পরস্পরের মধ্যে কিয়ৎপরিমাণে ভাবেরও যোগ রাখিয়াছেন। মোগল-সাম্রাজ্য যখন সম্পদে এবং ক্ষমতায় স্ফীত হইয়া একান্ত স্বার্থপর হইয়৷ উঠিল, যখন সে সম্রাটের পক্ষে ন্যায়পরতা অনাবশ্বক বোধ করিয়া, প্রজার সুখদু:খে একেবারে অন্ধ হইয়া পড়িল, তখন তাহার জাগরণের দিন উপস্থিত হইল । বিলাসিনী জেবউন্নিসাও মনে করিয়াছিল সম্রাট্রদুহিতার পক্ষে প্রেমের আবখ্যক নাই, সুখই একমাত্র শরণ্য । সেই সুখে অন্ধ হইয়া যখন সে দয়াধর্মের মস্তকে অাপন জরিজহরতজড়িত পাদুকাখচিত সুন্দর বামচরণখানি দিয়া পদাঘাত করিল তখন কোন অজ্ঞাত গুহাতল হইতে কুপিত প্রেম জাগ্রত হইয়া তাহার মর্মস্থলে দংশন করিল, শিরায় শিরায় মুখমন্থরগামী রক্তস্রোতের মধ্যে একেবারে আগুন বহিতে লাগিল, আরামের পুষ্পশয্যা চিতাশয্যার মতো তাহাকে দগ্ধ করিল – তখন সে ছুটিয়া বাহির হইয়া উপেক্ষিত প্রেমের কণ্ঠে বিনীত দীনভাবে সমস্ত সুখসম্পদের বরমাল্য সমর্পণ করিল— দুঃখকে স্বেচ্ছায় বরণ করিয়া হৃদয়াসনে অভিষেক করিল। তাহার পরে আর মুখ পাইল না, কিন্তু আপন সচেতন অন্তরাত্মাকে ফিরিয়া পাইল । জেবউন্নিসা সম্রাট্রপ্রাসাদের অবরুদ্ধ অচেতন আরামগর্ভ হইতে তীব্র যন্ত্রণার পর ধুলায় ভূমিষ্ঠ হইয়৷ উদার জগতীতলে জন্মগ্রহণ করিল। এখন হইতে সে অনন্ত জগৎবাসিনী রমণী ।