পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী راه 8 যুগান্তর যুগান্তর। সামাজিক উপন্যাস। ঐশিবনাথ শাস্ত্রী -বিরচিত শিবনাথবাবুর যুগান্তর’ উপন্যাসখানি পাঠ করিতে, করিতে কর্তব্যক্লান্ত সমালোচকের চিত্ত বহুকাল পরে আনন্দ এবং কৃতজ্ঞতায় উচ্ছসিত হইতেছিল। এমন পর্যবেক্ষণ, এমন চরিত্রস্বজন, এমন সরস হাস্য, এমন সরল সহৃদয়ত বঙ্গসাহিত্যে দুর্লভ। লেখক বিশ্বনাথ তর্কভূষণকে আমাদের নিকট পরমাত্মীয়ের ন্যায় পরিচিত করিয়া দিয়াছেন। এমন সত্য চরিত্র বাংলা উপন্যাসে ইতিপূর্বে কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। লেখক তাহাকে সমস্ত তুচ্ছ ঘটনার মধ্যে প্রত্যক্ষবৎ জাজল্যমান দেখিয়াছেন– তাহার চরিত্রটিকে প্রতিদিনের হাস্তে এবং অশ্রুজলে, দোষে এবং গুণে অতি সহজেই সজীব করিয়া তুলিয়াছেন। বিরলবসতি বঙ্গসাহিত্যরাজ্যে তর্কভূষণ মহাশয় যে একটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি করিলেন এবং আমরা যে একটি স্থায়ী বন্ধু लॉर्ड করিলাম সে বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহমাত্র নাই । কেবল তর্কভূষণকে কেন, লেখক বঙ্গসাহিত্যে নশিপুর নামক আস্ত-একটি গ্রাম বসাইয়া দিয়াছেন। এই গ্রামের ক্রিয়াকর্ম, আমোদপ্রমোদ, কৌতুক-উপদ্রব, স্বজনদুর্জন সমস্তই পাঠকদের চিরসম্পত্তি হইয়া গিয়াছে। তর্কভূষণের টোল, ‘হাসের দল’, চিমু ঘোষ, জহরলালের ইতিহাস নূতনগঠিত সদ্য-পঠিত হইলেও তাহ আমাদের নিকট যেন অনেক কালের পুরাতন পরিচিত হইয়া উঠিয়াছে। এ দিকে উলোর রামরতন মুখুজ্যের ঘরে তর্কভূষণের কন্য। ভুবনেশ্বরীর ঘরকন্নাও আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ সত্য এবং অত্যন্ত বেদনাজনক হইয়াছে। সংক্ষেপে তর্কভূষণ, তাহার গ্রাম, তাহার পরিবার, তাহার ছাত্রবর্গ, তাহার শক্রমিত্র সকলকে লইয়া একটি গ্রাম্যগ্রহমণ্ডলীর কেন্দ্রবর্তী স্বর্যের ন্যায় আমাদের নিকট প্রবল উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হইয়াছেন। এমন সময়ে আমাদের পরম দুর্ভাগ্যবশত উপন্যাসটি অকস্মাং যুগান্তরে লোকাস্তরে আসিয়া উপস্থিত হইল। কোথায় গেল তর্কভূষণ, নশিপুর, হাসের দল— কোথা হইতে উপস্থিত নবীনচন্দ্র, হাতিবাগান, নবরত্নসভা। গ্রন্থকারও নূতন বেশ ধারণ করিলেন। তিনি ছিলেন ঔপন্যাসিক, হইলেন ঐতিহাসিক ; ছিলেন ভাবুক, হইলেন নীতিপ্রচারক। আমরা রসসম্ভোগের সত্যযুগ হইতে তর্কবিতর্কের যুগান্তরে আসিয়া অবতীর্ণ হইলাম। গ্রন্থকার পূর্বে যেখানে মানুষ গড়িতেছিলেন এখন সেখানে মত গড়িতে লাগিলেন, পূর্বে যেখানে আনন্দনিকেতন ছিল এখন সেখানে পাঠশালা বসিয়া গেল ।