পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য (t Sసి বৈদিক ধর্মের সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া কোনো পণ্ডিত আজ পর্যন্ত হিন্দুধর্মের একটা অখণ্ড আদর্শ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন কি ? ইহা কি সকলের দ্বারা সাধ্য ? পৌরাণিক ধর্ম ঐতিহাসিক হিন্দুধর্ম। কালক্রমে হিন্দুর অনেক পরিবর্তন হইয়াছে। বৈদিক আর্যগণ যে সমাজ, যে রীতি, যে বিশ্বাস, যে মানসিক প্রকৃতি লইয়া ভারতবর্ষে প্রবেশ করিয়াছিলেন অনার্যদের সংঘর্ষে মিশ্রণে বিচিত্র অবস্থান্তরে স্বভাবের নিয়মে ক্রমশই তাহ রূপান্তরিত হইয়া আসিয়াছে। সেই-সকল নব নব অভিব্যক্তি নব নব পুরাণে আপনাকে আকারবদ্ধ করিয়াছে। বেদ যে অবস্থার শাস্ত্র, পুরাণ সে অবস্থার শাস্ত্র নহে। সুতরাং বেদকেই যদি প্রমাণ বলিয়া মানা যায় তবে পুরাণকে ছাড়িতে হয় এবং পুরাণকে প্রবল বলিয়৷ মানিলে বেদকে পরিহার করিতে হয়। এমন-কি গ্রন্থকার নিজে বলিয়াছেন এবং ফলেও দেখা যায়, এক পুরাণকে মানিলে অন্য পুরাণের সহিত বিরোধ বাধিয় উঠে। বর্তমানে হিন্দুসমাজ বেদকে মুখে মান্য করিয়া কাজের বেল পুরাণকে অবলম্বন করে। উভয়ের মধ্যে যে কোনোপ্রকার অসামঞ্জস্য আছে সে তর্ক উত্থাপিত হয় না । হিন্দুধর্মের এই ঐতিহাসিক অভিব্যক্তি আজ পর্যন্ত চলিয়া আসিতেছে। কারণ পুরাণ কেবল সংস্কৃত ভাষায় বদ্ধ নহে, প্রচলিত ভাষাতেও রচিত হয়। মনসার ভাসান, সত্যপীরের কথা প্রভৃতি তাহার দৃষ্টান্ত। মেয়েদের ব্ৰতকথাও তাহার উদাহরণ। অন্নদামঙ্গলে যদিও পৌরাণিক শিবদুর্গার লীলা বর্ণিত, এবং যদিও তাহার রচয়িত ভারতচন্দ্র শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, তথাপি তাহার মধ্যে জনসাধারণ-প্রচলিত আধুনিক কল্পনাবিকার সহজেই স্থানলাভ করিয়াছে। কবিকঙ্কণচণ্ডীতেও তাহাই। হরপার্বতীর কোন্দল, কোচ-নারীদের প্রতি শিবের আসক্তি, নিজের গাত্ৰমল দিয়া দুর্গ কর্তৃক খেলার পুত্তলি নির্মাণ ও তাহা হইতে গণেশের জন্ম এ-সমস্ত কাহিনী আধুনিক, প্রাদেশিক ; শ্রুতি ইহার মূল নহে, লোকের কল্পনাই ইহার মূল, দেবতাকে নিজ পরিমাপে নির্মাণচেষ্টাই ইহার প্রধান কারণ। ইহার মধ্যে উচ্চ অঙ্গের আধ্যাত্মিক রূপক বাহির করা সাধারণ লোকের পক্ষে অসাধ্য এবং অসাধারণ লোকের পক্ষেও দুঃসাধ্য । সংক্ষেপে আমাদের শেষ বক্তব্য এই যে, যে-সকল ভক্ত মহাপুরুষ চিরপ্রথাগত সাকার উপাসনা ত্যাগ করেন নাই তাহারা অসামান্য প্রতিভাবলে উদ্দীপ্ত ভাবাবেগে দৃষ্টিগোচরকেও দৃষ্টিপথাতীত করিয়া তুলিয়াছেন, বাধা তাহাদের নিকট বাধা নহে, র্যণ্ট গেন-আবিষ্কৃত রশ্মির ন্যায় তাহদের মন শতপ্রাচীরবেষ্টিত জড় আবরণ অনায়াসে ভেদ করিয়া চলিয়। যাইতে পারে। কিন্তু সাধারণ লোকের কাছে বাধা যে বাধ৷