পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শোকসভা বঙ্কিমের মৃত্যু উপলক্ষে শোকপ্রকাশ করিবার জন্য যাহারা সাধারণ সভা আহবানের চেষ্টা করিয়াছেন, শুনা যায়, তাহার একটি গুরুতর বাধা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন ; সে বাধা সর্বাপেক্ষ বিস্ময়জনক এবং তাহ পূর্বে প্রত্যাশা করা যায় নাই। যাহারা বঙ্কিমের বন্ধুত্বসম্পর্কে আপনাদিগকে গৌরবান্বিত জ্ঞান করেন এমন অনেক খ্যাতনামা লোক সভাস্থলে শোকপ্রকাশ করা কৃত্রিম আড়ম্বর বলিয়া তাহাতে যোগদান করিতে অসম্মত হইয়াছেন এবং সভার উদযোগিগণকে ভৎসনা করিতেও ক্ষাস্ত হন নাই। এরূপ বিয়োগ উপলক্ষে আপন অন্তরের আবেগ প্রকাশ্বে ব্যক্ত করাকে বোধ করি তাহারা পবিত্র শোকের অবমাননা বলিয়া জ্ঞান করেন। বিশেষত আমাদের দেশে কখনও এমন প্রথা প্রচলিত ছিল না, সুতরাং শোকের দিনে একটা অনাবশ্বক বিদেশী আড়ম্বরে মাতিয়া ওঠা কিছু অশোভন এবং অসময়েচিত বলিয়া মনে হইতে পারে। যখন আমাদের দেশের অনেক শ্রদ্ধেয় লোকের এইরূপ মত দেখা যাইতেছে তখন এ সম্বন্ধে আলোচনা আবশ্যক হইয়াছে। সাধারণের হিতৈষী কোনো মহৎব্যক্তির মৃত্যু হইলে সাধারণ সভায় তাহার গুণের আলোচনা করিয়া তাহার নিকটে কৃতজ্ঞতা স্বীকারপূর্বক শোকপ্রকাশ করার মধ্যে ভালোমন্দ আর যাহাই থাক, তাহ যে যুরোপীয়তা-নামক মহদোষে দুষ্ট সে কথা স্বীকার করিতেই হইবে। কিন্তু সেইসঙ্গে এ কথাও ভাবিয়া দেখিতে হইবে যে, যুরোপীয়দের সংসর্গবশতই হউক বা অন্যান্য নানা কারণে ইচ্ছাক্রমে ও অনিচ্ছাক্রমে আমাদের বাহ অবস্থা এবং মনের ভাবের কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটিতেছে ; কেবল রাগ করিয়া অস্বীকার করিয়া বিরক্ত হইয় তাহাকে লোপ করা যায় না। নূতন আবশ্বকের জন্ত নূতন উপায়গুলি অনভ্যাসবশত প্রথম-প্রথম যদি-বা কাহারও চক্ষে অপরিচিত অপ্রিয় বলিয়া বোধ হয় তথাপি বিবেচক ব্যক্তি ভালোরূপ বিচার না করিয়া তাহার নিন্দ করেন না । সহৃদয় লোকের নিকট কৃত্রিমতা অতিশয় অসহ্য হইয় থাকে এ কথা সর্বজন বিদিত। কিন্তু কৃত্রিমতার অনেক প্রকারভেদ আছে। একপ্রকার কৃত্রিমত ভিত্তি স্বরূপে সমাজকে ধারণ করিয়া রাখে, আর-একপ্রকার কৃত্রিমতা কীটের স্বরূপে সমাজকে জীর্ণ করিয়া ফেলে।