৫৩২ রবীন্দ্র-রচনাবলী ব্যক্তিদিগের প্রতি অক্ষুন্ন ভক্তি ও নির্ভর এই সমাজের প্রধান বন্ধন— এই কারণে গুরুজনের বিয়োগে শোকপ্রকাশ কেবল ব্যক্তিগত নহে, তাহ সমাজগত নিয়মের অধীন। এ সমাজ অনাবশ্বকবোধে পুত্ৰশোকের প্রতি কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করে নাই । সম্প্রতি এই গার্হস্থ্যপ্রধান সমাজের কিছু রূপান্তর ঘটিয়াছে। ইহার মধ্যে একটা নূতন বন্যার জল প্রবেশ করিয়াছে। তাহার নাম পাব্লিক। পদার্থটিও নূতন, তাহার নামও নূতন। বাংলা ভাষায় উহার অনুবাদ অসম্ভব। স্বতরাং পাব্লিক শব্দ এবং তাহার বিপরীতাৰ্থক প্রাইভেট শব্দ বাংলায় প্রচলিত হইয়াছে, কেবল এখনও জাতে উঠিয়া সাহিত্য-সভায় স্থান পায় নাই ; তাহাতে তাহাদের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নাই, সাহিত্যেরই সমূহ অসুবিধা। যখন কথাটা বলিবার দরকার হয় তখন শব্দটা কোনোমতে উচ্চারণ না করিয়া ভাবে ভঙ্গিতে ইশারায় ইঙ্গিতে সাধু সাহিত্যকে বহু কষ্টে কাজ চালাইতে হয়। কিন্তু এই বিদেশী শব্দটা যখন সাধারণের বোধগম্য হইয়াছে তখন আর এ-প্রকার দুরূহ ব্যায়ামের আবশ্বক" দেখি না । এক্ষণে আমাদের সমাজে যখন, কেবল গৃহ নহে, পাব্লিকের অস্তিত্বও ক্রমশ দীপ্যমান হইয়া উঠিয়াছে, তখন এখানে ক্রমে ক্রমে এক-একটি করিয়া পাব্লিক-কর্তব্যের আবির্ভাবও অবখ্যম্ভাবী। যেমন আমাদের দেশে পিতৃশ্ৰাদ্ধ প্রকাশ্য সভায় অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে এবং প্রত্যেক পিতৃহীন ব্যক্তির পিতৃশোক ব্যক্ত করা প্রকাশ কর্তব্যস্বরূপে গণ্য হয় তেমনি পাব্লিকের হিতৈষী কোনো মহৎ ব্যক্তির মৃত্যুতে প্রকাশু সভায় শোকজ্ঞাপন একটা সামাজিক কর্তব্যের মধ্যে গণ্য হওয়া উচিত। গার্হস্থ্যপ্রধান সমাজে প্রায় প্রত্যেক পিতাই বীর । তাহাদিগকে বিচিত্র কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে হয় এবং সমস্ত পরিবারের জন্য পদে পদে ত্যাগস্বীকার করিয়া আত্মস্থখ বিসর্জনপূর্বক চলিতে হয়। যাহাদের হিতের জন্য র্তাহার ধৈর্যের সহিত বীর্যসহকারে আমৃত্যুকাল সংসারের কঠিন কর্তব্যসকল সাবধানে পালন করিয়া চলেন তাহারা সর্বসমক্ষে সেই আত্মসুখে উদাসীন হিতব্ৰত গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি প্রদর্শন করিবে ইহা সমাজের শাসন । তেমনি, যাহার কেবল আপনার ঘরের জন্য নহে, পরস্তু পাব্লিকের হিতের জন্য আপন জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন, মৃত্যুর পরে তাহদের প্রতি প্রকাশু ভক্তি স্বীকার করা কি পাব্লিকের কর্তব্য নহে ? এবং প্রকাশ্বে ভক্তি স্বীকার করিতে গেলেই কি ব্যক্তিগত শোককে সংযমে আনা আবশ্বক হয় না ? এবং একজন বিশেষ বন্ধু রুদ্ধদ্বার গৃহের
