পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় ©8Ꮌ গিয়াছেন তাহাদিগকে মিশরের বিস্তীর্ণ মরুভূমির মধ্যে গুটিকতক নিঃসঙ্গ পিরামিডের মতো দেখিতে হয়। এই মৃত সমভূমির মধ্যে র্তাহীদের সমুন্নত মহিমা দ্বিগুণ দেদীপ্যমান হয় বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে একটি সুবিশাল বিষাদ হৃদয়কে বাষ্পাকুল করিয়া তোলে। হয়, এতবড়ো জীবন যাহার নিকট নিঃশেষে সমৰ্পিত হইয়াছে সে জানিতেও পারিল না তাহার কী সৌভাগ্য এবং সে চিরদিনের জন্য কতখানি লাভ করিল। ‘ভাবসম্পদকে আমরা এখনও যথার্থ সম্পদরূপে গণ্য করিতে শিখি নাই। সাহিত্যরস যে আমাদের জীবনের খাদ্যপানীয়ের ন্যায় অত্যাবশ্যক তাহ এখনও আমরা সম্যক অনুভব করি না। বঙ্কিমচন্দ্রের স্বজনী শক্তি মাতৃভাষার সহিত মিশ্রিত হইয়া বাঙালির জীবনের মজ্জার মধ্যে যে প্রবেশ করিয়াছে, বঙ্কিমের প্রতিভা-উৎসের ভাবপ্রস্রবণ হইতে বাঙালি যে নূতন জীবনরস প্রাপ্ত হইয়াছে, বঙ্কিমের আবির্ভাবের পূর্বে যেরূপ ছিল বঙ্কিমের আবির্ভাবের পরে বাঙালির জীবনের গঠনে যে তদপেক্ষ এক নূতন বৈচিত্রের সঞ্চার হইয়াছে তাহ এখনও আমরা সম্যক উপলব্ধি করিতে পারি নাই । ‘এই স্থলে যদি আমি প্রসঙ্গক্রমে বঙ্কিমচন্দ্রের সহিত নিজের জীবনের সম্বন্ধ আলোচনা করি তবে ভরসা করি শ্রোতৃগণ আমার সেই প্ৰগলভতাকে অহমিকা জ্ঞান করিয়া অপরাধ লইবেন না। আজিকার এই শোকের দিনে বঙ্কিমের নিকট কেবল স্বজাতির মহে নিজের নিজের বিশেষ কৃতজ্ঞতাঋণ স্বীকার করিবার জন্য আবেগ উপস্থিত হয় এবং তাহ দমন করা অবশ্যকর্তব্য বলিয়া বোধ করি না। ‘সৌভাগ্যক্রমে আমরা বাল্যকালে বাংলা ভাষায় বিদ্যাশিক্ষা লাভ করিয়াছিলাম । স্বল্প ইংরেজি যাহ। শিখিতাম তাহার মধ্য হইতে হৃদয়ের পোষণযোগ্য তৃপ্তিজনক কোনো রস আকর্ষণ করিবার ক্ষমতা ছিল না। অথচ তৃষ্ণ যথেষ্ট ছিল। কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস, একত্র বাধানো বিবিধার্থসংগ্রহ, আরব্য উপন্যাস, পারস্য উপন্যাস, বাংলা রবিনসন ক্রুসো, স্বশীলার উপাখ্যান, রাজা প্রতাপাদিত্যরায়ের জীবনচরিত, বেতালপঞ্চবিংশতি প্রভৃতি তখনকার কালের গ্রন্থগুলি বিস্তর পাঠ করিয়াছিলাম। তখন বাংলা গ্রন্থের সংখ্যা অল্প ছিল এবং বালকদিগের পাঠের অযোগ্য গ্রন্থও অনেক বাহির হইত। এবং আমরা অপরিতৃপ্ত আগ্রহের সহিত ভালোমন্দ সকল গ্রন্থই নির্বিচারে পাঠ করিতাম। তরুণ হৃদয়ের সেই স্বাভাবিক ক্ষুধা-উদ্রেকের সময় বঙ্কিমের নবীন। প্রতিভা লক্ষ্মীরূপে স্বধাভাও হন্তে লইয়া আমাদের সম্মুখে আবির্ভূত হইলেন। তখন যে নূতন আস্বাদ, নূতন আনন্দ, নূতন জীবন লাভ করিয়াছিলাম তাহ কোনো কালে ভূলিতে পারিব না।’