পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO)Or রবীন্দ্র-রচনাবলী আমিও নীলরতনের দৃষ্টাস্তে উৎসাহিত হইয়া একসময় বিশেষ সুবিধাযোগে কলিকাতায় পালাইয়া গেলাম। প্রথমে গ্রামের একটি আলাপী লোকের বাসায়ছিলাম, তাহার পরে বাপের কােছ হইতেও কিছু কিছু অধ্যয়নের সাহায্য পাইতে লাগিলাম। লেখাপড়া যথানিয়মে চলিতে লাগিল । ইহার উপরে আবার সভাসমিতিতেও যোগ দিতাম। দেশের জন্য হঠাৎ প্রাণবিসর্জন করা যে আশু আবশ্যক, এ সম্বন্ধে আমার সন্দেহ ছিল না। কিন্তু কী করিয়া উক্ত দুঃসাধ্য কাজ করা যাইতে পারে। আমি জানিতাম না, এবং কেহ দৃষ্টান্তও দেখাইত না। কিন্তু তাহারলিয়া উৎসাহের কোনো ত্রুটি ছিল না। আমরা পাড়াগেয়ে ছেলে, কলিকাতার ইচড়ে-পাকা ছেলের মতো সকল জিনিসকেই পরিহাস করিতে শিখি নাই, সুতরাং আমাদের নিষ্ঠা অত্যন্ত দৃঢ় ছিল। আমাদের সভার কর্তৃপক্ষীয়েরা বক্তৃতা দিতেন, আর আমরা চাদার খাতা লইয়া না-খাইয়া দুপুর রৌদ্রে টাে টাে করিয়া বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করিয়া বেড়াইতাম, রাস্তার ধারে দাড়াইয়া বিজ্ঞাপন বিলি করিতাম, সভাস্থলে গিয়া বেঞ্চি চৌকি সাজাইতাম, দলপতির নামে কেহ একটা কথা বলিলে কোমর বাঁধিয়া মারামারি করিতে উদ্যত হাইতাম । শহরের ছেলেরা এই সব লক্ষণ দেখিয়া আমাদিগকে বাঙালি বলিত । নাজির সেরেস্তাদার হইতে আসিয়ছিলাম, কিন্তু মািটসীনি গারিবালডি হইবার আয়োজন করিতে व्लाोिळी । এমন সময়ে আমার পিতা এবং সুরবালার পিতা একমত হইয়া সুরবালার সহিত আমার বিবাহের জন্য উদ্যোগী হইলেন । আমি পনেরো বৎসর বয়সের সময় কলিকাতায় পালাইয়া আসি, তখন সুরবালার বয়স আট ; এখন আমি আঠারো । পিতার মতে আমার বিবাহের বয়স ক্রমে উত্তীর্ণ হইয়া যাইতেছে। কিন্তু এদিকে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, আজীবন বিবাহ না করিয়া স্বদেশের জন্য মরিব— বাপকে বললাম, বিদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ সমাধা না করিয়া বিবাহ করিব না । দুই-চারি মাসের মধ্যে খবর পাইলাম, উকিল রামলোচনবাবুর সহিত সুরবালার বিবাহ হইয়া গিয়াছে। পতিত ভারতের চান্দা-আদায়কার্যে ব্যস্ত ছিলাম, এ সংবাদ অত্যন্ত তুচ্ছ বােধ হইল। এস্ট্রেন্স পাস করিয়াছি, ফাস্ট আর্টস দিব, এমন সময় পিতার মৃত্যু হইল। সংসারে কেবল আমি এক নই, মাতা এবং দুটি ভগিনী আছে। সুতরাং কলেজ ছাড়িয়া কাজের সন্ধানে ফিরিতে হইল। বহু চেষ্টায় নওয়াখালি বিভাগের একটি ছোটাে শহরে এস্ট্রেন্স স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারি পদ প্রাপ্ত হইলাম। মনে করিলাম, আমার উপযুক্ত কাজ পাইয়াছি। উপদেশ এবং উৎসাহ দিয়া এক-একটি ছাত্রকে ভাবী ভারতের এক-একটি সেনাপতি করিয়া তুলিব । কাজ আরম্ভ করিয়া দিলাম। দেখিলাম, ভাবী ভারতবর্ষ অপেক্ষা আসন্ন এগজামিনের তাড়া ঢের বেশি। ছাত্রদিগকে গ্রামার অ্যালজেব্রার বহির্ভূত কোনো কথা বলিলে হেড়মাস্টার রাগ করে। মাস-দুয়েকের মধ্যে আমারও উৎসাহ নিস্তেজ হইয়া আসিল । আমাদের মতো প্রতিভাহীন লোক ঘরে বসিয়া নানারাপ কল্পনা করে, অবশেষে কাৰ্যক্ষেত্রে নামিয়া ঘাড়ে লাঙল বহিয়া পশ্চাৎ হইতে ল্যাজমল খাইয়া নতশিরে সহিষ্ণুভাবে প্ৰত্যহিক মাটিভাঙার কাজ করিয়া সন্ধ্যাবেলায় একপেট জাবনা খাইতে পাইলেই সন্তুষ্ট থাকে ; লফে-বফে আর উৎসাহ থাকে না। অগ্নিদাহের আশঙ্কায় একজন করিয়া মাস্টার স্কুলের ঘরেতেই বাস করিত। আমি একা মানুষ, আমার উপরেই সেই ভার পড়িয়ছিল। স্কুলের বড়ো আটচালার সংলগ্ন একটি চালায় আমি বাস করিতাম। স্কুলঘরটি লোকালয় হইতে কিছু দূরে। একটি বড়ো পুষ্করিণীর ধারে। চারিদিকে সুপারি নরিকেল এবং মাদারের গাছ, এবং স্কুলগৃহের প্রায় গায়েই দুটা প্ৰকাণ্ড বৃদ্ধ নিমগাছ গায়ে গায়ে সংলগ্ন হইয়া ছায়া দান করিতেছে। একটা কথা এতদিন উল্লেখ করি নাই এবং এতদিন উল্লেখযোগ্য বলিয়া মনে হয় নাই। এখানকার সরকারি উকিল রামলোচন রায়ের বাসা আমাদের স্কুলঘরের অনতিদূরে। এবং তঁহার সঙ্গে তাহার স্ত্রীআমার বাল্যাসখী সুরবালা- ছিল, তাহা আমার জানা ছিল।