পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

R VS জীবিত ও মৃত প্রথম পরিচ্ছেদ রানীহটের জমিদার শারদাশংকর বাবুদের বাড়ির বিধবা বধূটর পিতৃকুলে কেহ ছিল না ; সকলেই একে একে মারা গিয়াছে। পতিকুলেও ঠিক আপনার বলিতে কেহ নাই, পতিও নাই পুত্ৰও নাই। একটি ভাশুরপো, শারদাশংকরের ছোটাে ছেলেটি, সেই তাহার চক্ষের মণি । সে জন্মিবার পর তাহার মাতার বহুকাল ধরিয়া শক্ত পীড়া হইয়াছিল, সেইজন্য এই বিধবা কাকি কাদম্বিনীই তাঁহাকে মানুষ করিয়াছে। পরের ছেলে মানুষ করিলে তাহার প্রতি প্ৰাণের টান আরো যেন বেশি হয়, কারণ তাহার উপরে অধিকার থাকে না ; তাহার উপরে কোনো সামাজিক দাবি নাই, কেবল মেহের দাবি- কিন্তু কেবলমাত্র স্নেহ সমাজের সমক্ষে আপনার দাবি কোনো দলিল অনুসারে সপ্রমাণ করিতে পারে না এবং চাহেও না, কেবল অনিশ্চিত প্ৰাণের ধনটিকে দ্বিগুণ ব্যাকুলতার সহিত ভালোবাসে। 确 বিধবার সমস্ত রুদ্ধ শ্ৰীতি এই ছেলেটির প্রতি সিঞ্চন করিয়া একদিন শ্রাবণের রাত্রে কাদম্বিনীর অকস্মাৎ মৃত্যু হইল। হঠাৎ কী কারণে তাহার হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হইয়া গেল— সময় জগতের আর-সর্বত্রই চলিতে লাগিল, কেবল সেই স্নেহকাতর ক্ষুদ্র কোমল বক্ষটির ভিতর সময়ের ঘড়ির কল চিরকালের মতো বন্ধ হইয়া গেল । পাছে পুলিসের উপদ্রব ঘটে এইজন্য অধিক আড়ম্বর না করিয়া জমিদারের চারিজন ব্রাহ্মণ কর্মচারী অনতিবিলম্বে মৃতদেহ দাহ করিতে লইয়া গেল। রানীহাটের শ্মশান লোকালয় হইতে বহুদূরে । পুষ্করিণীর ধারে একখানি কুটির এবং তাহার নিকটে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ, বৃহৎ মাঠে আর-কাথাও কিছু নাই। পূর্বে এইখন দিয়া নদী বাহিত, এখন নদী একেবারে শুকাইয়া গেছে। সেই শুষ্ক জলপথের এক অংশ খনন করিয়া শ্মশানের পুষ্করিণী নির্মিত হইয়াছে। এখনকার লোকেরা এই পুষ্করিণীকে পুণ্য স্রোতস্বিনীর প্রতিনিধিস্বরূপ জ্ঞান করে। মৃতদেহ কুটিরের মধ্যে স্থাপন করিয়া চিতার কাঠ আসিবার প্রতীক্ষায় চারজনে বসিয়া রহিল । সময় এত দীর্ঘ বোধ হইতে লাগিল যে অধীর হইয়া চারিজনের মধ্যে নিতাই এবং গুরুচরণ কাঠ আনিতে এত বিলম্ব হইতেছে কেন দেখিতে গেল, বিধু এবং বনমালী মৃতদেহ রক্ষা করিয়া বসিয়া রহিল। শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রি । থমথমে মেঘ করিয়া আছে, আকাশে একটি তারা দেখা যায় না ; অন্ধকার ঘরে দুইজনে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। একজনের চাদরে দিয়াশলাই এবং বাতি বাধা ছিল। বর্ষাকালের দিয়াশলাই বহু চেষ্টাতেও জ্বলিল না- যে-লণ্ঠন সঙ্গে ছিল তাহাও নিবিয়া গেছে। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া একজন কহিল, “ভাই রে, এক ছিলিম তামাকের জোগাড় থাকিলে বড়ো সুবিধা হইত। তাড়াতাড়ি কিছুই আনা হয় নাই।” ܝ অন্য ব্যক্তি কহিল, “আমি চট্ৰ করিয়া এক দৌড়ে সমস্ত সংগ্ৰহ করিয়া আনিতে পারি।” বনমালীর পলায়নের অভিপ্রায় বুঝিয়া বিধু কহিল, “মাইরি! আর, আমি বুঝি এখানে একলা বসিয়া থাকিব ।” আবার কথাবার্তা বন্ধ হইয়া গেল। পাঁচ মিনিটকে এক ঘণ্টা বলিয়া মনে হইতে লাগিল। যাহারা কাঠ আনিতে গিয়াছিল, তাহাদিগকে মনে মনে ইহারা গালি দিতে লাগিল- তাহারা যে দিব্য আরামে কোথাও সুগন্ধ করতে করতে তামাক হইতেছে। এ সত্বে কমই তাহলে মেন শ্ৰীভূত হয় উঠতে १ळ्न | কোথাও কিছু শব্দ নাই- কেবল পুষ্করিণীতীর হইতে অবিশ্রাম ঝিল্লি এবং ভেকের ডাক শুনা যাইতেছে। এমন সময়ে মনে হইল যেন খাটটা ঈষৎ নড়িল- যেন মৃতদেহ পাশ ফিরিয়া শুইল । বিধু এবং বনমালী রামনাম জপিতে জপিতে কঁাপিতে লাগিল। হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা দীর্ঘনিশ্বাস শুনা গৈল । বিধু এবং বনমালী এক মুহুর্তে ঘর হইতে লাফ দিয়া বাহির হইয়া গ্রামের অভিমুখে দৌড় দিল । d! R)