পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

外欧@冈 NOVO মনে হইল যমুনার প্রত্যেক তরঙ্গ হইতে বাঁশি বাজিয়া উঠিল; মনে হইল, আকাশের প্রত্যেক তারা যেন সেই বঁশির ছিদ্র-অবশেষে কুঞ্জে কুঞ্জে, পথে ঘাটে, ফুলে ফলে, জলে স্থলে, উচ্চ নীচে, অন্তরে বাহিরে বঁাশি সর্বত্র হইতে বাজিতে লাগিল-বাশি কী বলিতেছে তাহা কেহ বুঝিতে পারিল না এবং বঁশির উত্তরে হৃদয় কী বলিতে চাহে, তাহাও কেহ স্থির করিতে পারিল না ; কেবল দুটি চক্ষু ভরিয়া অশ্রুজল জাগিয়া উঠিল এবং একটি অলোকসুন্দর শ্যামস্নিগ্ধ মরণের আকাঙক্ষায় সমস্ত প্ৰাণ যেন উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল। সভা ভুলিয়া, রাজা ভুলিয়া, আত্মপক্ষ প্রতিপক্ষ ভুলিয়া, যশ-অপযশ জয়পরাজয় উত্তরপ্রত্যুত্তর সমস্ত ভুলিয়া শেখর আপনার নির্জন হৃদয়কুঞ্জের মধ্যে যেন একলা দাঁড়াইয়া এই বঁশির গান গাহিয়া গেলেন। কেবল মনে ছিল একটি জ্যোতির্ময়ী মানসী মূর্তি, কেবল ক্যানে বাজিতেছিল দুটি কমলাচরণের নূপূরধ্বনি। কবি যখন গান শেষ করিয়া হতজ্ঞানের মতো বসিয়া পড়িলেন তখন একটি অনির্বচনীয় মাধুর্যে-- একটি বৃহৎ ব্যাপ্ত বিরহব্যাকুলতায় সভাগৃহ পরিপূর্ণ হইয়া রহিল, কেহ সাধুবাদ দিতে পারিল না। এই ভাবের প্রবলতার কিঞ্চিৎ উপশম হইলে পুণ্ডৱীক সিংহাসনসম্মুখে উঠিলেন। প্রশ্ন করিলেন, “রাধাই বা কে, কৃষ্ণই বা কে।” বলিয়া চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিলেন এবং শিষ্যদের প্রতি চাহিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া পুনরায় প্রশ্ন করিলেন, “রাধাই বা কে, কৃষ্ণই বা কে।” বলিয়া অসামান্য পাণ্ডিত্য বিস্তার করিয়া আপনি তাহার উত্তর দিতে আরম্ভ করিলেন। বলিলেন, “রাধা প্রণব ওঁকার, কৃষ্ণ ধ্যানযোগ, এবং বৃন্দাবন দুই ভুর মধ্যবর্তী বিন্দু।” ইড়া, সুষুম্না, পিঙ্গলা, নাভিপদ্ম, হৃৎপদ্ম, ব্ৰহ্মরন্ধ, সমস্ত আনিয়া ফেলিলেন। ‘রা' অর্থেই বা কী, ‘ধী অর্থেই বা কী, কৃষ্ণ শব্দের কি হইতে মূর্ধন্য ‘ণ পর্যন্ত প্রত্যেক অক্ষরের কত প্রকার ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হইতে পারে, তাহার একে একে মীমাংসা করিলেন। একবার বুঝাইলেন, কৃষ্ণ যজ্ঞ, রাধিক অগ্নি, একবার বুঝাইলেন, কৃষ্ণ বেদ এবং রাধিক ষড়দর্শন ; তাহার পরে বুঝাইলেন কৃষ্ণ শিক্ষা এবং রাধিক দীক্ষা। রাধিক তর্ক, কৃষ্ণ মীমাংসা ; ; রাধিক উত্তরপ্রত্যুত্তর, কৃষ্ণ জয়লাভ। এই বলিয়া রাজার দিকে, পণ্ডিতের দিকে এবং অবশেষে তীব্ৰ হাস্যে শেখরের দিকে চাহিয়া পুণ্ডৱীক বসিলেন । রাজা পুণ্ডৱীকের আশ্চর্য ক্ষমতায় মুগ্ধ হইয়া গেলেন, পণ্ডিতদের বিস্ময়ের সীমা রহিল না এবং কৃষ্ণরাধাের নব নব ব্যাখ্যায় বাঁশির গান, যমুনার কল্লোল, প্রেমের মোহ একেবারে দূর হইয়া গেল ; যেন পৃথিবীর উপর হইতে কে একজন বসন্তের সবুজ রঙটুকু মুছিয়া লইয়া আগাগোড়া পবিত্ৰ গোময় লেপন করিয়া গেল। শেখর আপনার এতদিনকার সমস্ত গান বৃথা বোধ করিতে লাগিলেন ; ইহার পরে তঁহার আর গান গাহিবার সামর্থ্য রহিল না । সেদিন সভা ভঙ্গ হইল । 8 পরদিন পুণ্ডৱীক ব্যস্ত এবং সমস্ত, দ্বিব্যস্ত এবং দ্বিসমস্তক, বৃত্ত, তার্ক্য, সীেত্র, চক্ৰ, পদ্ম, কাকপদ, আদ্যুত্তর, মধ্যোত্তর, অস্তোত্তর, বাক্যোিত্তর, শ্লোকোত্তর, বচনগুপ্ত, মাত্ৰাচুতক, চুতদত্তাক্ষর, অর্থগৃঢ়, স্তুতিনিন্দা, অপর্তুতি, শুদ্ধাপভ্রংশ, শাদী, কালসার, প্ৰহেলিকা প্রভৃতি অদ্ভুত শব্দচাতুরী দেখাইয়া দিলেন। শুনিয়া সভাসুদ্ধ লোক বিস্ময় রাখিতে স্থান পাইল না। শেখর যে-সকল পদ রচনা করিতেন তাহা নিতান্ত সরল— তাহা সুখে দুঃখে উৎসবে আনন্দে সর্বসাধারণে ব্যবহার করত-আজ তাহারা স্পষ্ট বুঝিতে পারিল, তাহাতে কোনো গুণাপনা নাই, যেন তাহা ইচ্ছা করিলেই তাহারাও রচনা করিতে পারিত কেবল অনভ্যাস অনিচ্ছা অনবসর ইত্যাদি কারণেই পারে ন- নহিলে কথাগুলো বিশেষ নূতনও নহে দুরূহও নহে, তাহাতে পৃথিবীর লোকের নূতন একটা শিক্ষাও হয় না। সুবিধাও হয় না- কিন্তু আজ যাহা শুনিল তাহা অদ্ভুত ব্যাপার, কাল যাহা শুনিয়াছিল তাঁহাতেও বিস্তর চিন্তা এবং শিক্ষার বিষয় ছিল। পুণ্ডৱীকের পণ্ডিত্য ও নৈপুণ্যের নিকট তাঁহাদের আপনার কবিটিকে নিতান্ত বালক ও সামান্য লোক বলিয়া মনে হইতে লাগিল।