পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\08Ve রবীন্দ্র-রচনাবলী ফটিক কহিল, “না, মারি নি।” “ফের মিথ্যে কথা বলছিস ।” “কখখনো মারি নি। মাখনকে জিজ্ঞাসা করে।” মাখনকে প্রশ্ন করাতে মাখন আপনার পূর্ব নালিশের সমর্থন করিয়া বলিল, “হা, মেরেছে।” তখন আর ফটিকের সহ্য হইল না। দ্রুত গিয়া মাখনকে এক সশব্দ চড় কষাইয়া দিয়া কহিল, “ফের মিথ্যে কথা !” মা মাখনের পক্ষ লইয়া ফটিককে সবেগে নাড়া দিয়া তাহর পৃষ্ঠে দুটা-তিনটা প্রবল চপেটাঘাত করিলেন। ফটিক মাকে ঠেলিয়া দিল । মা চীৎকার করিয়া কহিলেন, “অ্যা, তুই আমার গায়ে হাত তুলিস !” এমন সময়ে সেই কঁচাপাকা বাবুট ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, “কী হচ্ছে তোমাদের।” ফটিকের মা বিস্ময়ে আনন্দে অভিভূত হইয়া কহিলেন, “ওমা, এ যে দাদা, তুমি কবে এলে।” বলিয়া গড় । করিয়া প্ৰণাম করিলেন । বহুদিন হইল দাদা পশ্চিমে কাজ করিতে গিয়াছিলেন, ইতিমধ্যে ফটিকের মাের দুই সন্তান হইয়াছে, তাহারা অনেকটা বাড়িয়া উঠিয়াছে, তাহার স্বামীর মৃত্যু হইয়াছে, কিন্তু একবারও দাদার সাক্ষাৎ পায় নাই। আজ বহুকাল পরে দেশে ফিরিয়া আসিয়া বিশ্বম্ভরবাবু তাহার ভগিনীকে দেখিতে আসিয়াছেন । কিছুদিন খুব সমারোহে গেল। অবশেষে বিদায় লইবার দুই-একদিন পূর্বে বিশ্বস্তুরবাবু তাহার ভগিনীকে ছেলেদের পড়াশুনা এবং মানসিক উন্নতি সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলেন। উত্তরে ফটিকের অবাধ্য উদ্ধৃঙ্খলতা, পাঠে অমনোযোগ, এবং মাখনের সুশান্ত সুশীলতা ও বিদ্যানুরাগের বিবরণ শুনিলেন । । র্তাহার ভগিনী কহিলেন, “ফটিক আমার হাড় জ্বালাতন করিয়াছে।” শুনিয়া বিশ্বম্ভর প্রস্তাব করিলেন, তিনি ফটিককে কলিকাতায় লইয়া গিয়া নিজের কাছে রাখিয়া শিক্ষা দিবেন । বিধবা এ প্রস্তাবে সহজেই সম্মত হইলেন । ফটিককে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন রে ফটিক, মামার সঙ্গে কলকাতায় যাবি ?” ফটিক লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, “যাব।” যদিও ফটিককে বিদায় করিতে তাহার মায়ের আপত্তি ছিল না, কারণ র্তাহার মনে সর্বদাই আশঙ্কা ছিলকোনদিন সে মাখনকে জলেই ফেলিয়া দেয় কি মােথই ফাটায় কি কী একটা দুর্ঘটনা ঘটায়, তথাপি ফটিকের বিদায়গ্রহণের জন্য এতাদৃশ আগ্রহ দেখিয়া তিনি ঈষৎ ক্ষুন্ন হইলেন। ‘কবে যাবে, কখন যাবে করিয়া ফটিক তাহার মামাকে অস্থির করিয়া তুলিল ; উৎসাহে তাহার রাত্রে নিদ্রা হয় না । অবশেষে যাত্রাকালে আনন্দের ঔদার্যবশত তাহার ছিপ ঘুড়ি লাটাই সমস্ত মাখনকে পুত্রপৌত্ৰাদিক্ৰমে ভোগদখল করিবার পুরা অধিকার দিয়া গেল। কলিকাতায় মামার বাড়ি পীেছিয়া প্রথমত মামির সঙ্গে আলাপ হইল। মামি এই অনাবশ্যক পরিবারবৃদ্ধিতে মনে মনে যে বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, তাহা বলিতে পারিনা। র্তাহার নিজের তিনটি ছেলে লইয়া তিনি নিজের নিয়মে ঘরকায়া পাতিয়া বসিয়া আছেন, ইহার মধ্যে সহসা একটি তেরো বৎসরের অপরিচিত অশিক্ষিত পাড়াগোঁয়ে ছেলে ছাড়িয়া দিলে কিরূপ একটা বিপ্লবের সম্ভাবনা উপস্থিত হয়। বিশ্বস্তুরের এত বয়স হইল, তবু কিছুমাত্র যদি জ্ঞানকাণ্ড আছে। বিশেষত, তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠাম এবং কথামােত্রই প্ৰগলভতা। হঠাৎ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বাড়িয়া উঠে; লোকে সেটা তাহার একটা কুগ্ৰী স্পর্ধস্বরূপ জ্ঞান করে। তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়, লোকে সেজন্য তাহাকে মনে মনে