পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

fireb 8962፩ বিরসমূখে শশিভূষণের নিকট গিয়া দাঁড়াইলেন। শশিভূষণ ব্যস্তসমস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাধে, তোমায় এমন দেখিতেছি। কেন । অসুখ হয় নাই তো ?” । r রাধামুকুন্দ মৃদুস্বরে ধীরে ধীরে কহিলেন, “দাদা, আর তো আমার এখানে থাকা হয় না।” এই বলিয়া গত সন্ধ্যাকালে বড়োগৃহিণীর আক্রমণবৃত্তান্ত সংক্ষেপে এবং শান্তভাবে বর্ণনা করিয়া গেলেন। শশিভূষণ হাসিয়া কহিলেন, “এই ! এ তো নূতন কথা নহে। ও তো পরের ঘরের মেয়ে, সুযোগ পাইলেই দুটাে কথা বলিবে, তাই বলিয়া কি ঘরের লোককে ছাড়িয়া যাইতে হইবে। কথা আমাকেও তো মাঝে মাঝে শুনিতে হয়, তাই বলিয়া তো সংসার ত্যাগ করিতে পারি না।” রাধা কহিলেন, “মেয়েমানুষের কথা কি আর সহিতে পারি না, তবে পুরুষ হইয়া জন্মিলাম কী করিতে। কেবল ভয় হয়, তোমার সংসারে পাছে অশান্তি ঘটে।” । শশিভূষণ কহিলেন, “তুমি গেলে আমার কিসের শান্তি ।” 朝 আর অধিক কথা হইল না। রাধামুকুন্দ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চলিয়া গেলেন, তাহার হৃদয়ভার রহিল । এদিকে বড়োগৃহিণীর আক্রোশ ক্রমশই বাড়িয়া উঠিতেছে। সহস্ৰ উপলক্ষে যখন তখন তিমি রাধাকে খোটা দিতে পারিলে ছাড়েন না ; মুহুর্মুহু বাক্যবাণে রাসমণির অন্তরাত্মাকে একপ্রকার শরশয্যাশায়ী করিয়া তুলিলেন। রাধা। যদিও চুপচাপ করিয়া তামাক টানেন এবং স্ত্রীকে ক্ৰন্দনােন্মুখী দেখিবামাত্র চােখ বুজিয়া নাক ডাকাইতে আরম্ভ করেন, তবু ভাবে বোধ হয় তাহারও অসহ্য হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু শশিভূষণের সহিত র্তাহার.সম্পর্ক তো আজিকার নহে-দুই ভাই যখন প্রাতঃকালে পান্তাভাত খাইয়া পাততাড়ি কক্ষে একসঙ্গে পাঠশালায় যাইত, উভয়ে যখন একসঙ্গে পরামর্শ করিয়া গুরুমহাশয়কে ফাকি দিয়া পাঠশালা হইতে পালাইয়া রাখাল-ছেলেদের সঙ্গে মিশিয়া নানাবিধ খেলা ফাদিত, এক বিছানায় শুইয়া স্তিমিত আলোকে মাসির নিকট গল্প শুনিত, ঘরের লোককে লুকাইয়া রাত্রে দূর পল্লীতে যাত্রা শুনিতে যাইত এবং প্ৰাতঃকালে ধরা পড়িয়া অপরাধ এবং শান্তি উভয়ে সমান ভাগ করিয়া লইত- তখন কোথায় ছিল ব্রজসুন্দরী, কোথায় ছিল রাসমণি । জীবনের এতগুলো দিনকে কি একদিনে বিচ্ছিন্ন করিয়া চলিয়া যাওয়া যায়। কিন্তু এই বন্ধন যে স্বার্থপরতার বন্ধন, এই প্রগাঢ় গ্ৰীতি যে পরান্নপ্রত্যাশার সুচতুর ছদ্মবেশ, এরূপ সন্দেহ এরূপ আভাসমােত্র তাহার নিকট বিষ তুল্য বোধ হইত, অতএব আর কিছুদিন এরূপ চলিলে কী হইত বলা যায় না। কিন্তু এমন সময়ে একটা গুরুতর ঘটনা ঘটিল। যে-সময়ের কথা বলিতেছি তখন নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে গবর্মেন্টের খাজনা শোধ না করিলে জমিদারি সম্পত্তি নিলাম হইয়া যাইত । 虹 একদিন খবর আসিল, শশিভূষণের একমাত্র জমিদারি পরগণা এনাংশাহী লাটের খাজনার দায়ে নিলাম হইয়া গেছে । ༨ রাধামুকুন্দ ঠাঁহার স্বাভাবিক মৃদু প্রশান্তভাবে কহিলেন, “আমারই দােষ।” শশিভূষণ কহিলেন, “তোমার কিসের দোষ। তুমি তো খাজনা চালান দিয়াছিলে, পথে যদি ডাকাত পড়িয়া লুটিয়া লয়, তুমি তাহার কী করিতে পাের।” দোষ কাহার এক্ষণে তাহা স্থির করিতে বসিয়া কোনো ফল নাই- এখন সংসার চালাইতে হইবে । শশিভূষণ হঠাৎ যে কোনাে কাজকর্মে হাত দিবেন, সেরূপ তাহার স্বভাব ও শিক্ষা নহে। তিনি যেন ঘাটের বাধা সোপান হইতে পিছলিয়া একমুহূর্তে ডুবজলে গিয়া পড়িলেন। i প্রথমেই তিনি স্ত্রীর গহনা বন্ধক দিতে উদ্যত হইলেন। রাধামুকুন্দ এক থলে টাকা সম্মুখে ফেলিয়া তাহাতে বাধা দিলেন। তিনি পূর্বেই নিজ স্ত্রীর গহনা বন্ধক রাখিয়া যথোপযুক্ত অর্থসংগ্ৰহ করিয়াছিলেন। সংসারে একটা এই মহৎ পরিবর্তন দেখা গেল, সম্পংকালে গৃহিণী যাহাকে দূর করিবার সহস্ৰ চেষ্টা করিয়াছিলেন, বিপংকালে তাহাকে ব্যাকুলভাবে অবলম্বন করিয়া ধরিলেন। এই সময়ে দুই ভ্রাতার মধ্যে কাহার উপরে অধিক নির্ভর করা যাইতে পারে, তাহা বুধিয়া লইতে র্তাহার বিলম্ব হইল না। কখনো যে