পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVV রবীন্দ্র-রচনাবলী হরসুন্দরী কিছুদিন হইতে এই কথা ভাবিতেছিল। মনে যখন একটা প্রবল আনন্দ, একটা বৃহৎ প্রেমের সঞ্চার হয় তখন মানুষ মনে করে আমি সব করিতে পারি। তখন হঠাৎ একটা আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা বলবতী হইয়া উঠে। স্রোতের উচ্ছস যেমন কঠিন তািটর উপর আপনাকে সবেগে মূৰ্হিত করে, তেমনি প্রেমের আবেগ, আনন্দের উন্মুস একটা মহং ত্যাগ একটা বৃহৎ দুঃখের উপর আপনাকে যেন নিক্ষেপ করিতে R | সেইরূপ অবস্থায় অত্যন্ত পুলকিত চিত্তে একদিন হরসুন্দরী স্থির করিল, আমার স্বামীর জন্য আমি খুব বড়ো একটা কিছুকরিব। কিন্তু হায়, যতখানিসাধ ততখানিসাধ্যকাহার আছে। হাতের কাছে কী আছে, কী দেওয়া যায়। ঐশ্বৰ্য নাই, বুদ্ধি নাই, ক্ষমতা নাই, শুধু একটা প্ৰাণ আছে, সেটাও যদি কোথাও দিবার থাকে এখনই দিয়া ফেলি, কিন্তু তাঁহারই বা মূল কী। আর, স্বামীকে যদি দুগ্ধফেনের মতো শুভ্ৰ, নবনীর মতো কোমল, শিশুকন্দৰ্পের মতো সুন্দর একটি মেহের পুত্তলি সস্তান দিতে পরিতাম ! কিন্তু প্ৰাণপণেইচ্ছা করিয়া মরিয়া গেলেও তো সে হইবে না। তখন মনে হইল, স্বামীর একটি বিবাহ দিতে হইবে। ভাবিল, স্ত্রীরা ইহাতে এত কাতর হয় কেন, এ কাজ তো কিছুই কঠিন নহে। স্বামীকে যে ভালোবাসে, সপত্নীকে ভালোবাসা তাহার পক্ষে কী এমন অসাধ্য। মনে কবিয়া বক্ষ স্ফীত হইয়া উঠিল। প্রস্তাবটা প্রথম যখন শুনিল, নিবারণ হাসিয়া উড়াইয়া দিল, দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বারও কর্ণপাত করিল না। স্বামীর এই অসম্মতি, এই অনিচ্ছা দেখিয়া হরসুন্দরীর বিশ্বাস এবং সুখ যতই বাড়িয়া উঠিল। তাহার अठिठ७ ऊ७३ ग्रू श्७ जाीिल। এদিকে নিবারণ যত বারংবার এই অনুরোধ শুনিল, ততই ইহার অসম্ভাব্যতা তাহার মন হইতে দূর হইল এবং গৃহদ্বারে বসিয়া তামাক খাইতে খাইতে সন্তানপরিবৃত গৃহের সুখময় চিত্র তাহার মনে উজ্জ্বল হইয়া উঠিতে লাগিল। : করিতে পারিব না।” হরসুন্দরী কহিল, “সেজন্য তোমাকে ভাবিতে হইবে না। মানুষ করিবার ভার আমার উপর রহিল।” বলিতে বলিতে এই সন্তানহীনা রমণীর মনে একটি কিশোরবয়স্ক, সুকুমারী, লজ্জাশীলা, মাতৃক্রোড় হইতে সদ্যোবিচুত নববধূর মুখচ্ছবি উদয় হইল এবং হৃদয় স্নেহে বিগলিত হইয়া গেল। নিবারণ কহিল, “আমার আপিস আছে, কাজ আছে, তুমি আছ, কচি মেয়ের আবদার শুনিবার অবসর পাইব না।” হরসুন্দরী বার বার করিয়া কহিল, তাহার জন্য কিছুমাত্র সময় নষ্ট করিতে হইবে না। এবং অবশেষে পরিহাস করিয়া কহিল, “আচ্ছা গো, তখন দেখিব, কোথায় বা তোমার কাজ থাকে, কোথায় বা আমি থাকি, আর কোথায় বা তুমি থাক।” নিবারণ সে কথার উত্তরমাত্র দেওয়া আবশ্যক মনে করিল না, শাস্তির স্বরূপ হরসুন্দরীর কাপোলে তর্জনী আঘাত করিল। এই তো গেল ভূমিকা । একটি নোলক পরা অশ্রুভরা ছোটোখাটাে মেয়ের সহিত নিবারণের বিবাহ হইল, তাহার নাম শৈলবালা । নিবারণ ভাবিল, নামটি বড়ো মিষ্ট এবং মুখখনিও বেশ ঢলেঢ়লো। তাহার ভাবখানা, তাহার চেহারাখনি, তাহার চলাফোেবা একটু বিশেষ মনোযোগ করিয়া চাহিয়া দেখিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সে আর কিছুতেই হইয়া উঠে না। উলটিয়া এমন ভাব দেখাইতে হয় যে, ঐ তো একফোঁটা মেয়ে, উহাকে লইয়া তো বিষম বিপদে পড়িলাম, কোনোমতে পাশ কাটাইয়া আমার বয়সোচিত কর্তব্যক্ষেত্রের মধ্যে গিয়া পড়িলে যেন পরিত্রাণ পাওয়া যায় ।