পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

邪g愿 VVA হরসুন্দরী নিবারণের এই বিষম বিপদগ্ৰস্ত ভাব দেখিয়া মনে মনে বড়ো আমোদ বােধ করিত। এক-একদিন হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিত, “আহা, পালাও কোথায়। ঐটুকু মেয়ে, ও তো আর তোমাকে খাইয়া ফেলিবে না।” নিবারণ দ্বিগুণ শশব্যস্ত ভােব ধারণ করিয়া বলিত, “আরো রোসো রোসো, আমার একটু বিশেষ কাজ আছে।” বলিয়া যেন পালাইবার পথ পাইত না। হরসুন্দরী হাসিয়া দ্বার আটক করিয়া বলিত, আজ ফাঁকি দিতে পরিবে না। অবশেষে নিবারণ নিতান্তই নিরুপায় হইয়া কাতরভাবে বসিয়া পড়িত। হরসুন্দরী তাহার কানের কাছে বলিত, “আহা, পরের মেয়েকে ঘরে আনিয়া অমন হতশ্রদ্ধা করিতে নাই।” এই বলিয়া শৈলবালাকে ধরিয়া নিবারণের বাম পাশে বসাইয়া দিত এবং জোর করিয়া ঘোমটা খুলিয়া ও চিবুক ধরিয়া তাহার আনত মুখ তুলিয়া নিবারণকে বলিত, “আহা, কেমন চাঁদের মতো মুখখানি দেখো (अशि ।” কোনোদিন বা উভয়কে ঘরে বসাইয়া কাজ আছে বলিয়া উঠিয়া যাইত এবং বাহির হইতে বানাৎ করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিত। নিবারণ নিশ্চয় জানিত দুটি কৌতুহলী চক্ষু কোনো-না-কোনাে ছিদ্রে সংলগ্ন হইয়া আছে- অতিশয় উদাসীনভাবে পােশ ফিরিয়া নিদ্রার উপক্ৰম করিত, শৈলবালা ঘোমটা টানিয়া গুটিসুটি মারিয়া মুখ ফিরাইয়া একটা কোণের মধ্যে মিলাইয়া থাকিত। অবশেষে হরসুন্দরী নিতান্ত না পারিয়া হাল ছাড়িয়া দিল, কিন্তু খুব বেশি দুঃখিত হইল না। হরসুন্দরী যখন হাল ছাড়িল, তখন স্বয়ং নিবারণ হাল ধরল। এ বড়ো কৌতুহল, এ বড়ো রহস্য! এক টুকরা হীরক পাইলে তাহাকে নানা ভাবে নানা দিকে ফিরাইয়া দেখিতে ইচ্ছা করে, আর এ একটি ক্ষুদ্র সুন্দর মানুষের মন— বড়ো অপূর্ব ! ইহাকে কতরকম করিয়া স্পর্শ করিয়া, সােহাগ করিয়া, অন্তরাল হইতে, সম্মুখ হইতে, পার্শ্ব হইতে দেখিতে হয়। কখনো একবার কানের দুলে দোলদিয়া, কখনাে ঘোমটা একটুখানি টানিয়া তুলিয়া, কখনাে বিদ্যুতের মতো সহসা সচকিতে, কখনাে নক্ষত্রের মতো দীর্ঘকাল একদৃষ্টি নব নব সৌন্দর্যের সীমা আবিষ্কার করিতে হয় । ম্যাকমোরান কোম্পানির আপিসের হেডবাবু শ্ৰীযুক্ত নিবারণচন্দ্রের অদৃষ্ট এমন অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে হয় নাই। সে যখন প্রথম বিবাহ করিয়াছিল তখন বালক ছিল, যখন যৌবন লাভ করিল। তখন স্ত্রী তাহার নিকট চিরপরিচিত, বিবাহিত জীবন চিরাভ্যস্ত। হরসুন্দরীকে অবশ্যই সে ভালোবাসিত, কিন্তু কখনোই তাহার মনে ক্ৰমে ক্ৰমে প্রেমের সচেতন সঞ্চার হয় নাই । একেবারে পাকা আম্রের মধ্যেই যে পতঙ্গ জন্মলাভ করিয়াছে, যাহাকে কোনাে কালে রস অন্বেষণ করিতে হয় নাই, অল্পে অল্পে রসাস্বাদ করিতে হয় নাই, তাহাকে একবার বসন্তকালের বিকশিত পুষ্পবনের মধ্যে ছাডিয়া দেওয়া হউক দেখি- বিকচােমুখ গোলাপের আধাখোলা মুখটির কাছে ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহার কী । আগ্রহ। একটুকু যে সৌরভ পায়, একটুকু যে মধুর আস্বাদ লাভ করে তাঁহাতে তাহার কী নেশা । নিবারণ প্রথমটা কখনো বা একটা গাউনপরা কাচের পুতুল, কখনাে বা এক শিশি এসেন্স, কখনাে বা কিছু মিষ্টদ্রব্য কিনিয়া আনিয়া শৈলবালাকে গোপনে দিয়া যাইত। এমনি করিয়া একটুখানি ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত হয়। অবশেষে কখন একদিন হরসুন্দরী গৃহকার্যের অবকাশে আসিয়া দ্বারের ছিদ্ৰ দিয়া দেখিল, নিবারণ এবং শৈলবালা বসিয়া কড়ি লইয়া দশ-পঁচিশ খেলিতেছে। বুড়াবয়সের এই খেলা বটে ! নিবারণ সকলে আহারাদি করিয়া যেন আপিসে বাহির হইল। কিন্তু আপিসে না গিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়াছে। এ প্রবঞ্চনার কী আবশ্যক ছিল। হঠাৎ একটা জ্বলন্ত বজশলাকা দিয়া কে যেন হরসুন্দরীর চােখ খুলিয়া দিল, সেই তীব্ৰতাপে চােখের জল বাষ্প হইয়া শুকাইয়া গেল। হরসুন্দরী মনে মনে কহিল, আমিই তাে উহাকে ঘরে আনিলাম, আমিই তো মিলন করাইয়া দিলাম, তবে আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন- যেন আমি উহাদের সুখের কাটা । হরসুন্দরী শৈলবালাকে গৃহকাৰ্যশিখাইত। একদিন নিবারণ মুখ ফুটিয়া বলিল, “ছেলেমানুষ, উহাকে তুমি বড়ো বেশি পরিশ্রম করাইতেছ, উহার শরীর তেমন সবল নহে।”