পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

oey রবীন্দ্র-রচনাবলী । বড়ো একটা তীব্ৰ উত্তর হরসুন্দরীর মুখের কাছে আসিয়াছিল; কিন্তু কিছু বলিল না, চুপ করিয়া গেল। সেই অবধি বউকে কোনো গৃহকার্যে হাত দিতে দিত না ; রাধাবাড়া দেখাশুনা সমস্ত কাজ নিজে করিত। এমন হইল, শৈলবালা আর নড়িয়া বসিতে পারে না, হরসুন্দরী দাসীর মতো তাহার সেবা করে এবং স্বামী বিদূষকের মতো তাহার মনােরঞ্জন করে। সংসারের কাজ করা, পরের দিকে তাকানাে, যে জীবনের কর্তব্য এ শিক্ষাই তাহার হইল না। হরসুন্দরী যে নীরবে দাসীর মতো কাজ করিতে লাগিল তাহার মধ্যে ভারি একটা গৰ্ব আছে। তাহার মধ্যে নূনতা এবং দীনতা নাই। সে কহিল, তােমরা দুই শিশুতে মিলিয়া খেলা করে, সংসারের সমস্ত ভার আমি লইলাম । তৃতীয় পরিচ্ছেদ হায়, আজ কোথায় সে বল, যে বলে হরসুন্দরী মনে করিয়াছিল স্বামীর জন্য চিরজীবনকাল সে আপনার প্রেমের দাবির অর্ধেক অংশ অকাতরে ছাড়িয়া দিতে পারবে। হঠাৎ একদিন পূর্ণিমার রাত্রে জীবনে যখন জোয়ার আসে, তখন দুই কূল প্লাবিত করিয়া মানুষ মনে করে, আমার কোথাও সীমা নাই। তখন যে একটা বৃহৎ প্রতিজ্ঞা করিয়া বসে, জীবনের সুদীর্ঘ ভাটার সময় সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিতে তাহার সমস্ত প্ৰাণে টান পড়ে। হঠাৎ ঐশ্বর্যের দিনে লেখনীর এক আঁচড়ে যে দানপত্র লিখিয়া দেয়, চিরদারিদ্র্যের দিনে পলে পালে তিল তিল করিয়া তাহা শোধ করিতে হয়। তখন বুঝা যায় মানুষ বড়ো দীন, হৃদয় বড়ো দুর্বল, তাহার ক্ষমতা অতি যৎসামান্য । দীর্ঘ রোগাবসানে ক্ষীণ, রক্তহীন, পাণ্ডু কলেবরে হরসুন্দরী সেদিন শুক্ল দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো একটি শীর্ণ রেখামাত্র ছিল ; সংসারে নিতান্ত লঘু হইয়া ভাসিতেছিল। মনে হইয়াছিল, আমার যেন কিছুই না হইলেও, চলে। ক্ৰমে শরীর বলী হইয়া উঠিল, রক্তের তেজ বাড়িতে লাগিল, তখন হরসুন্দরীর মনে কোথা হইতে একদল শরিক আসিয়া উপস্থিত হইল, তাহারা উচ্চৈঃস্বরে কহিল, তুমি তো ত্যাগপত্র লিখিয়া বসিয়া আছ কিন্তু আমাদের দাবি আমরা ছাড়িব না। হরসুন্দরী যেদিন প্রথম পরিষ্কাররূপে আপন অবস্থা বুঝিতে পারিল, সেদিন নিবারণ ও শৈলবালাকে আপন শয়নগৃহ ছাড়িয়া দিয়া ভিন্ন গৃহে একাকিনী গিয়া শয়ন করিল। আট বৎসর বয়সে বাসররাত্রে যে-শয্যায় প্রথম শয়ন করিয়াছিল, আজ সাতাশ বৎসর পরে সেই শয্যা ত্যাগ করিল। প্ৰদীপ নিভাইয়া দিয়া এই সধবা রমণী যখন অসহ্য হৃদয়ভার লইয়া তাহারনূতন বৈধব্যশয্যার উপরে আসিয়া পড়িল, তখন গলির অপর প্রান্তে একজন শৌখিন যুবা বেহাগ রাগিণীতে মালিনীর গান গাহিতেছিল ; আর একজন বীয়া-তবলায় সংগত করিতেছিল এবং শ্ৰোতৃবন্ধুগণ সমের কাছে হাঃ-হাঃ করিয়া চীৎকার করিয়া উঠিতেছিল। তাহার সেই গান সেই নিস্তব্ধ জ্যোৎস্নারাত্রে পার্থের ঘরে মন্দ শুনাইতেছিল না। তখন বালিক শৈলবালার ঘুমে চােখ ঢুলিয়া পড়িতেছিল, আর নিবারণ তাহার কানের কাছে মুখ রাখিয়া ধীরে ধীরে उांकिडछिल, जई। 詹 লোকটা ইতিমধ্যে বঙ্কিমবাবুর চন্দ্ৰশেখর পড়িয়া ফেলিয়াছে এবং দুই-একজন আধুনিক কবির কাব্যও শৈলবালাকে পড়িয়া শুনাইয়াছে। lI নিবারণের জীবনের নিম্নস্তরে যে একটি যৌবন-উৎস বরাবর চাপা পড়িয়া ছিল, আঘাত পাইয়া হঠাৎ বড়ো অসময়ে তাহা উচ্ছসিত হইয়া উঠিল। কেহই সেজন্য প্রস্তুত ছিল না, এই হেতু অকস্মাৎ তাহার বুদ্ধিাশুদ্ধি এবং সংসারের সমস্ত বন্দোবস্ত উলটাপালটা হইয়া গেল। সে বেচারা কোনােকালে জানিত না মানুষের ভিতরে এমন সকল উপদ্রবজনক পদার্থ থাকে, এমন সকল দুৰ্দাম দুরন্ত শক্তি, যাহা সমস্ত হিসাবকিতাব শৃঙ্খলা সামঞ্জস্য একেবারে নয়ছয় করিয়া দেয়।