পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

- w9ዓo রবীন্দ্র-রচনাবলী নিবারণ চলিয়া গেলে ধীরে ধীরে উঠিয়া লোহার সিন্দুক খুলিয়া একে একে সমস্ত গহনা বাহির করিল। শৈলবালাকে ডাকিয়া প্ৰথমে আপনার বিবাহের বেনরসি শাড়িখনি পরাইল, তাহার পর তাহার। আপাদমস্তক এক-একখানি করিয়া গহনায় ভরিয়া দিল। ভালো করিয়া চুল বাধিয়া দিয়া প্ৰদীপ জ্বলিয়া দেখিল, বালিকার মুখখানি বড়ো সুমিষ্ট, একটি সদ্যঃপঙ্ক সুগন্ধ ফলের মতো নিটােল রসপূর্ণ। শৈলবালা যখন ঝমােঝম শব্দ করিয়া চলিয়া গেল, সেই শব্দ বহুক্ষণ ধরিয়া হরসুন্দরীর শিরার রক্তের মধ্যে বিমঝিম করিয়া বাজিতে লাগিল। মনে মনে কহিল, আজ আর কী লইয়া তোতে আমাতে তুলনা হইবে। কিন্তু এক সময়ে আমারও তো ঐ বয়স ছিল, আমিও তো অমনি যৌবনের শেষরেখা পর্যন্ত ভরিয়া উঠিয়ছিলাম, তবে আমাকে সে কথা কেহ জানায় নাই কেন। কখন সেদিন আসিল এবং কখন সেদিন গেল তাহা একবার সংবাদও পাইলাম । ना । किछु दी १, दी (ोंौद्भद, शै। उद्भछ छूनिश भलबाला निशाएछ । হরসুন্দরী যখন কেবলমাত্র ঘরকন্নাই জানিত তখন এই গহনাগুলি তাহার কাছে কত দামি ছিল। তখন কি নির্বোধের মতো এ-সমস্ত এমন করিয়া এক মুহুর্তে হাতছাড়া করিতে পারিত। এখন ঘরকন্না ছাড়া আর একটা বড়ো কিসের পরিচয় পাইয়াছে, এখন গহনার দাম, ভবিষ্যতের হিসাব সমস্ত তুচ্ছ হইয়া গিয়াছে। আর শৈলবালা সোনামানিক ঝকমক করিয়া শয়নগৃহে চলিয়া গেল, একবার মুহুর্তের তরে ভাবিলও না হরসুন্দরী তাহাকে কতখানি দিল। সে জানিল, চতুর্দিক হইতে সমস্ত সেবা, সমস্ত সম্পদ, সমস্ত সৌভাগ্য স্বাভাবিক নিয়মে তাহার মধ্যে আসিয়া পরিসমাপ্ত হইবে, কারণ সে হইল শৈলবালা, সে হইল সই ; পঞ্চম পরিচ্ছেদ এক-একজন লোক স্বপ্নবস্থায় নিভীকভাবে অত্যন্ত সংকটের পথ দিয়া চলিয়া যায়, মুহূৰ্তমাত্র চিন্তা করে না। অনেক জাগ্ৰত মানুষেরও তেমনি চিরস্বপ্নবস্থা উপস্থিত হয়, কিছুমাত্র জ্ঞান থাকে না, বিপদের সংকীর্ণ পথ দিয়া নিশ্চিন্তমনে অগ্রসর হইতে থাকে, অবশেষে নিদারুণ সর্বনাশের মধ্যে গিয়া জাগ্রত হইয়া উঠে । আমাদের ম্যাকমােরান কোম্পানির হেডবাবুটিরও সেই দশা। শৈলবালা তাহার জীবনের মাঝখানে একটা প্রবল আবর্তের মতো ঘুরিতে লাগিল এবং বহুদূর হইতে বিবিধ মহার্যপদাৰ্থ আকৃষ্ট হইয়া তাহার মধ্যে বিলুপ্ত হইতে লাগিল। কেবল যে নিবারণের মনুষ্যত্ব এবং মাসিক বেতন, হরসুন্দরীর সুখসৌভাগ্য এবং বসনভূষণ, তাহা নহে, সঙ্গে সঙ্গে ম্যাকমোরান কোম্পানির ক্যাশ তহবিলেও গোপনে টান পড়িল। তাহার মধ্য হইতেও দুটা-একটা করিয়া তোড়া অদৃশ্য হইতে লাগিল। নিবারণ স্থির করিত, আগামী মাসের বেতন হইতে আস্তে আস্তে শোধ করিয়া রাখিব। কিন্তু আগামী মাসের বেতনটি হাতে আসিবামাত্র সেই আবর্ত হইতে টান পড়ে এবং শেষ দু-আনিটি পর্যন্ত চকিতের মতো চিকমিক করিয়া বিদ্যুদবেগে অন্তৰ্হিত হয়। “ শেষে একদিন ধরা পড়িল । পুরুষানুক্রমের চাকুরি। সাহেব বড়ো ভালোবাসে, তহবিল পূরণ করিয়া দিবার জন্য দুইদিনমাত্র সময় দিল। কেমন করিয়া সে ক্রমে ক্রমে আড়াই হাজার টাকার তহবিল ভাঙিয়াছে তাহা নিবারণ নিজেই বুঝিতে পারিল না । একেবারে পাগলের মতো হইয়া হরসুন্দরীর কাছে গেল, বলিল, “সর্বনাশ হইয়াছে।” হরসুন্দরী সমস্ত শুনিয়া একেবারে পাংশুবৰ্ণ হইয়া গেল। নিবারণ কহিল, “শীঘ্ৰ গহনাগুলো বাহির করো।” হরসুন্দরী কহিল, “সে তো আমি সমস্ত ছোটােবউকে দিয়াছি।” নিবারণ নিতান্ত শিশুর মতো অধীর হইয়া বলিতে লাগিল, “কোন দিলে ছোটাে বউকে । কেন দিলে । কে তোমাকে দিতে বলিল।” হরসুন্দরী তাহার প্রকৃত উত্তর না দিয়া কহিল, “তাহাতে ক্ষতি কী হইয়াছে। সে তাৈ আর জলে পড়ে नाश् ।” ভীরু নিবারণ কাতরস্বরে কহিল, “তবে যদি তুমি কোনো ছুতা করিয়া তাহার কােছ হইতে বাহির করিতে পার। কিন্তু আমার মাথা খাও, বলিয়ে না যে আমি চাহিতেছি কিংবা কী জন্য চাহিতেছি।”