পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ 8 OG সে লাইনটি এই— যশিকে আমি খুব ভালোবাসি। A কেহ না মনে করেন। আমি এইবার একটা প্রেমের গল্প বানাইতে বসিয়াছি। যশিপাড়ার কোনো একাদশ কিংবা দ্বাদশবষীয় বালক নহে। বাড়ির একটি পুরাতন দাসী, তাহার প্রকৃত নাম যশোদা। কিন্তু যশির প্রতি বালিকার প্রকৃত মনোভােব কী এই এক কথা হইতে তাহার কোনো দৃঢ় প্রমাণ পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে যিনি বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস লিখিতে ইচ্ছা করিবেন, তিনি এই খাতাতেই দু-পাতা অন্তরে পূর্বোক্ত কথাটির সুস্পষ্ট প্রতিবাদ দেখিতে পাইবেন। এমন একটা-আধটা নয়, উমর রচনায় পদে পদে পরস্পরবিরোধিতা-দোষ লক্ষিত হয়। একস্থলে দেখা গেল- হরির সঙ্গে জন্মের মতো আড়ি । (হরিচরণ নয়, হরিদাসী, বিদ্যালয়ের সহপাঠিকা।) তার অনতিদূরেই এমন কথা আছে যাহা হইতে সহজেই বিশ্বাস জন্মে যে, হরির মতো প্রাণের বন্ধু তাহার আর न्छ । "ঠাকুর প্রকারে বালিকার বসে জন্য হচ্ছে, তখন কোন সকালরেল ইন্তে তাদের বাড়িতে সানাই বাজিতে লাগিল। উমার বিবাহ। বরটির নাম প্যারীমােহন, গােবিন্দলালের সহযোগী লেখক। বয়স যদিও অধিক নয় এবং লেখাপড়া কিঞ্চিৎ শেখা আছে, তথাপি নব্যভােব তার মনে কিছুমাত্র প্রবেশ করিতে পারে নাই। এইজন্য পাড়ার লোকেরা তাকে ধন্য ধন্য করিত এবং গোবিন্দলাল তাহার অনুকরণ করিতে চেষ্টা করিত, কিন্তু সম্পূর্ণ কৃতকার্য হইতে পারে নাই। উমা বেনরসি শাড়ি পরিয়া ঘোমটায় ক্ষুদ্র মুখখানি আবৃত করিয়া কঁদিতে কঁাদিতে শ্বশুরবাড়ি গেল ! মা বলিয়া দিলেন, “বাছা, শাশুড়ির কথা মানিয়া চলিস, ঘরকন্নার কাজ করিস, লেখাপড়া লইয়া থাকিস নে ৷” গোবিন্দলাল বলিয়া দিলেন, “দেখিস, সেখানে দেয়ালে আঁচড় কাটিয়া বেড়াস নে ; সে তেমন বাড়ি নয়। আর প্যারীমােহনের কোনাে লেখার উপরে খবরদার কলম চালাস নে ৷” বালিকার হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। তখন বুঝিতে পারিল, সে যেখানে যাইতেছে, সেখানে কেহ তাহাকে মার্জনা করিবে না । এবং তাহারা কাহাকে দোষ বলে, অপরাধ বলে, ত্রুটি বলে, তাহা অনেক ভৎসনার পর অনেকদিনে শিখিয়া লইতে হইবে । সেদিন সকালেও সানাই বাজিতেছিল। কিন্তু সেই ঘোমটা এবং বেনারসি শাড়ি এবং অলংকারে মণ্ডিত ক্ষুদ্র বালিকার কম্পিত হৃদয়টুকুর মধ্যে কী হইতেছিল তাহা ভালো করিয়া বোঝে এমন একজনও সেই লোকারণ্যের মধ্যে ছিল কি না সন্দেহ । Kr যশিও উমর সঙ্গে গেল। কিছুদিন থাকিয়া উমাকে শ্বশুরবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করিয়া সে চলিয়া আসিবে 0भनेि कशों छिल । স্নেহশীলা যশি অনেক বিবেচনা করিয়া উমার খাতটি সঙ্গে লইয়া গিয়াছিল। এই খাতাটি তাহার পিতৃভবনের একটি অংশ ; তাহার অতিক্ষণিক জন্মগৃহবাসের স্নেহময় স্মৃতিচিহ্ন ; পিতামাতার অঙ্কস্থলীর । একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, অত্যন্ত বঁকাচোরা কাচা অক্ষরে লেখা। তাহার এই অকাল গৃহিণীপনার মধ্যে বালিকীস্বভাবরোচক একটুখানি স্নেহমধুর স্বাধীনতার আস্বাদ । শ্বশুরবাড়ি গিয়া প্রথম কিছুদিন সে কিছুই লেখে নাই, সময়ও পায় নাই। অবশেষে কিছুদিন পরে যশি তাহার পূর্বস্থানে চলিয়া গেল। সেদিন উমা দুপুরবেলা শয়নগৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়া টিনের বাক্স হইতে খাতটি বাহির করিয়া কঁদিতে কঁদিতে লিখিল- যশি বাড়ি চলে গেছে, আমিও মার কাছে যাব। আজকাল চারুপাঠ এবং বােধােদয় হইতে কিছু কপি করিবার অবসর নাই,বােধ করি তেমন ইচ্ছাও নাই। সুতরাং আজকাল বালিকার সংক্ষিপ্ত রচনার মধ্যে মধ্যে দীর্ঘ বিচ্ছেদ নাই। পূর্বোদধূত পদটির পরেই দেখা যায় লেখা আছে- দাদা যদি একবার বাড়ি নিয়ে যায় তা হলে দাদার লেখা আর কখনো খারাপ করে দেব N শুনা যায় উমর পিতা উমাকে প্রায় মাঝে মাঝে বাড়ি আনিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু গােবিন্দলাল প্যারীমোহনের সঙ্গে যোগ দিয়া তাহার প্রতিবন্ধক হয়।