পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8SV রবীন্দ্র-রচনাবলী বনের পাখি বলে, “না? আমি শিকলে ধরা নাহি দিব । খাচার পাখি বলে, “হয়, আমি কেমনে বনে বহিরিব।” আমাদের বাড়ির ভিতরের ছাদের প্রাচীর আমার মাথা ছাড়াইয়া উঠিত। যখন একটু বড়ো হইয়াছি এবং চাকরদের শাসন কিঞ্চিৎ শিথিল হইয়াছে, যখন বাড়িতে নূতন বধূসমাগম হইয়াছে এবং অবকাশের সঙ্গীরূপে র্তাহার কাছে প্রশ্ৰয় লাভ করিতেছি, তখন এক-একদিন মধ্যাহ্নে সেই ছাদে আসিয়া উপস্থিত হইতাম। তখন বাড়িতে সকলের আহার শেষ হইয়া গিয়াছে; গৃহকর্মে ছেদ পড়িয়াছে; অন্তঃপুর বিশ্রামে নিমগ্ন ; স্নানসিক্ত শাড়িগুলি ছাদের কার্নিসের উপর হইতে বুলিতেছে ; উঠানের কোণে যে উচ্ছিষ্ট ভাত পড়িয়ছে তাহারই উপর কাকের দলের সভা বসিয়া গেছে। সেই নির্জন অবকাশে প্রাচীরের রান্ধের ভিতর হইতে এই খাচার পাখির সঙ্গে ঐ বনের পাখির চঞ্চুতে চঞ্চুতে পরিচয় চলিত। দাড়াইয়া চাহিয়া থাকিতাম- চোখে পড়িত আমাদের বাড়ির ভিতরের বাগান-প্রান্তের নরিকেলশ্রেণী ; তাহারই ফাঁক দিয়া দেখা যাইত ‘সিঙ্গির বাগান পল্লীর একটা পুকুর, এবং সেই পুকুরের ধারে যে তারা গয়লানী আমাদের দুধ দিত। তাঁহারই গোয়ালঘর ; আরো দূরে দেখা যাইত তরুচুড়ার সঙ্গে মিশিয়া কলিকাতা শহরের নানা আকারের ও নানা আয়তনের উচ্চনীচ ছাদের শ্রেণী:মধ্যাহ্নরৌদ্রে প্রখর শুভ্রতা বিছুরিত করিয়া পূর্বদিগন্তের পাণ্ডুবৰ্ণনীলিমার মধ্যে উধাও হইয়া চলিয়া গিয়াছে। সেই সকল অতিদূর বাড়ির ছাদে এক-একটা চিলেকােঠা উচু হইয়া থাকিিত ; মনে হইত, তাহারা যেন নিশ্চল তৰ্জনী তুলিয়া চোখ টিপিয়া আপনার ভিতরকার রহস্য আমার কাছে সংকেতে বলিবার চেষ্টা করিতেছে। ভিক্ষুক যেমন প্রাসাদের বাহিরে দাড়াইয়া রাজভাণ্ডারের রুদ্ধ সিন্ধুকগুলার মধ্যে অসম্ভব রত্নমানিক কল্পনা করে, আমিও তেমনি ঐ অজানা বাড়িগুলিকে কত খেলা ও কত স্বাধীনতার আগাগোড়া বোঝাই করা মনে করিতাম তাহা বলিতে পারি না। মাথার উপরে আকাশব্যাপী খরদীপ্তি, তাহারই দূরতম প্রান্ত হইতে চিলের সূক্ষ্ম তীক্ষ ডাক আমার কানে আসিয়া পীেছত এবং সিঙ্গির বাগানের পাশের গলিতে দিবাসুপ্ত নিস্তব্ধ বাড়িগুলার সম্মুখ দিয়া পসারী সুর করিয়া চাই, চুড়ি চাই, খেলোনা চাই হাকিয়া যাইত- তাহাতে আমার সমস্ত মনটা উদাস করিয়া দিত। পিতৃদেব প্রায়ই ভ্ৰমণ করিয়া বেড়াইতেন, বাড়িতে থাকিতেন না। র্তাহার তেতালার ঘর বন্ধ থাকিত । খড়খড়ি খুলিয়া হাত গলাইয়া, ছিটিকিনি টানিয়া দরজা খুলিতাম এবং তঁহার ঘরের দক্ষিণ প্রান্তে একটি সোফা ছিল- সেইটিতে চুপ করিয়া পড়িয়া আমার মধ্যাহ্ন। কাটিত । একে তো অনেক দিনের বন্ধ করা ঘর, নিষিদ্ধপ্রবেশ, সে-ঘরে যেন একটা রহস্যের ঘন গন্ধ ছিল। তাহার পরে সম্মুখের জনশূন্য খোলা ছাদের উপর রৌদ্র বঁা বঁা করিত, তাহাতেও মনটাকে উদাস করিয়া দিত। তার উপরে আরো একটা আকর্ষণ ছিল! তখন সবেমাত্র শহরে জলের কল হইয়াছে। তখন নূতন মহিমার ঔদার্যে বাঙালিপাড়াতেও তাহার কার্পণ্য শুরু হয় নাই। শহরের উত্তরে দক্ষিণে তাহার দাক্ষিণ্য সমান ছিল। সেই জলের কলের সত্যযুগে আমার পিতার স্নানের ঘরে তেতালাতেও জল পাওয়া যাইত। ঝাঁঝরি খুলিয়া দিয়া অকালে মনের সাধ মিটাইয়া স্নান করিতাম। সে-স্নান আরামের জন্য নহে, কেবলমাত্র ইচ্ছাটাকে লাগাম ছাড়িয়া দিবার জন্য। একদিকে মুক্তি, আর-একদিকে বন্ধনের আশঙ্কা, এই দুইয়ে মিলিয়া কোম্পানির কােলর জলের ধারা আমার মনের মধ্যে পুলকশর বর্ষণ করিত। বাহিরের সংস্রব আমার পক্ষে যতই দুর্লভ থাক, বাহিরের আনন্দ আমার পক্ষে হয়তো সেই কারণেই সহজ ছিল। উপকরণ প্রচুর থাকিলে মনটা কুঁড়ে হইয়া পড়ে ; সে কেবলই বাহিরের উপরেই সম্পূর্ণ বরাত দিয়া বসিয়া থাকে, ভুলিয়া যায়, আনন্দের ভোজে বাহিরের চেয়ে অন্তরের অনুষ্ঠানটাই গুরুতর। শিশুকালে মানুষের সর্বপ্রথম শিক্ষাটাই এই। তখন তাহার সম্বল অল্প এবং তুচ্ছ, কিন্তু আনন্দলাভের পক্ষে ইহার চেয়ে বেশি তাহার কিছুই প্রয়ােজন নাই। সংসারে যে হতভাগ্য শিশু খেলার জিনিস অপর্যাপ্ত পাইয়া থাকে তাহার খেলা মাটি হইয়া যায় । ।