পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জীবনস্মৃতি 8 Qs ছিল না। সাক্ষীর মধ্যে ছিল আমার অশ্রািজল। সেই ফৌজদারিতে আমি জিতিয়াছিলাম এবং সেই পরিচয়ের পর হইতে গোবিন্দবাবু আমাকে করুণার চক্ষে দেখিতেন। একদিন ছুটির সময় তাহার ঘরে আমার হঠাৎ ডাক পড়িল। আমি ভীতচিত্তে র্তাহার সম্মুখে গিয়া দাড়াইতেই তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি নাকি কবিতা লেখা।” কবুল করিতে ক্ষণমাত্র দ্বিধা করিলাম না। মনে নাইকী একটা উচ্চ অঙ্গের সুনীতি সম্বন্ধে তিনি আমাকে কবিতা লিখিয়া আনিতে আদেশ করিলেন। গােবিন্দবাবুর মতাে ভীষণগভীর লোকের মুখ হইতে কবিতা লেখার এই আদেশ যে কিরূপ অদ্ভুত সুললিত, তাহা যাহারা তঁহার ছাত্র নহেন ঠাহারা বুঝিবেন না। পরদিন লিখিয়া যখন তঁহাকে দেখাইলাম তিনি আমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া ছাত্রবৃত্তির ক্লাসের সম্মুখে দাঁড় করাইয়া দিলেন। বলিলেন, “পড়িয়া । শোনাও ” আমি উচ্চৈঃস্বরে আবৃত্তি করিয়া গেলাম। এই নীতিকবিতাটির প্রশংসা করিবার একটিমাত্র বিষয় আছে— এটি সকাল সকাল হারাইয়া গেছে। ছাত্রবৃত্তি ক্লাসে ইহার নৈতিক ফল যাহা দেখা গেল তাহা আশাপ্রদ নহে। অন্তত, এই কবিতার দ্বারায় শ্ৰোতাদের মনে কবির প্রতি কিছুমাত্ৰ সদভাবসঞ্চার হয় নাই। অধিকাংশ ছেলেই আপনাদের মধ্যে বলাবলি করিতে লাগিল, এ লেখা নিশ্চয়ই আমার নিজের রচনা নহে। একজন বলিল, যে ছাপার বই হইতে এ লেখা চুরি সে তাহা আনিয়া দেখাইয়া দিতে পারে। কেহই তাহাকে দেখাইয়া দিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিল না। বিশ্বাস করাই তাহদের আবশ্যক- প্ৰমাণ করিতে গেলে তাহার ব্যাঘাত হইতে পারে। ইহার পরে কবিযশঃপ্রার্থীর সংখ্যা বাড়িতে লাগিল। তাহারা যে পথ অবলম্বন করিল। তাহা নৈতিক উন্নতির প্রশস্ত পথ । নহে । এখনকার দিনে ছোটােছেলের কবিতা লেখা কিছুমাত্র বিরল নহে। আজকাল কবিতার গুমর একেবারে ফাক হইয়া গিয়াছে। মনে আছে, তখন দৈবাৎ যে দুই-একজনমাত্র স্ত্রীলোক কবিতা লিখিতেন তাহাদিগকে বিধাতার আশ্চর্যসৃষ্টি বলিয়া সকলে গণ্যকরিত। এখন যদি শুনি, কোনাে স্ত্রীলোক কবিতা লেখেন না, তবে সেইটেই এমন অসম্ভব বোধ হয় যে, সহজে বিশ্বাস করিতে পারি না। কবিত্বের অন্ধুর এখনকার কালে উৎসাহের অনাবৃষ্টিতেও ছাত্রবৃত্তি ক্লাসের অনেক পূর্বেই মাথা তুলিয়া উঠে। অতএব, বালকের যে কীর্তিকাহিনী এখানে উদঘাটিত করিলাম, তাহাতে বর্তমানকালের কোনো গোবিন্দবাবু বিস্মিত হইবেন না। শ্ৰীকণ্ঠবাবু এই সময়ে একটি শ্রোতা লাভ করিয়াছিলাম— এমন শ্রোতা আর পাইব না।” ভালো লাগিব।ার শক্তি ইহর । এতই অসাধারণ যে মাসিকপত্রের সংক্ষিপ্ত-সমালোচক-পদলাভেরাইমি একেবারেই অযোগ্য। বৃদ্ধ একেবারে সুপক বােম্বাই আমটির মতো- অমরসের আভাসমােত্রবর্জিত-ৰ্তাহার স্বভাবের কোথাও এতটুকু আঁশও ছিল না। মাথা-ভরা টাক, গোফদাড়ি-কামানাে স্নিগ্ধ মধুর মুখ, মুখবিবরের মধ্যে দন্তের কোনাে বালাই ছিল না, বড়ো বড়ো দুই চক্ষু অবিরাম হাস্যে সমুজ্জ্বল। তঁহার স্বাভাবিক ভারী গলায় যখন কথা কহিতেন তখন তীহার সমস্ত হাত মুখ চােখ কথা কহিতে থাকিত। ইনি সেকালের ফারসি-পড়া রসিক মানুষ, ইংরেজির কোনাে ধার ধারিতেন না। তাহার বামপার্থের নিত্যসঙ্গিনী ছিল একটি গুড়গুড়ি, কোলে কোলে সর্বদাই ফিরিত একটি সেতার, এবং কণ্ঠে গানের আর বিশ্রাম ছিল না। পরিচয় থােক। আর নাই থাক, স্বাভাবিক হৃদ্যতার জোরে মানুষমাত্রেরই প্রতি তাহার এমন একটি অবাধ অধিকার ছিল যে কেহই সেটি অস্বীকার করিতে পারিত না। বেশ মনে পড়ে, তিনি একদিন আমাদের লইয়া একজন ইংরেজ ছবিওয়ালার দোকানে ছবি তুলিতে গিয়াছিলেন। তাহার সঙ্গে হিন্দিতে বাংলাতে তিনি ১ “ইনি রায়পুরের সিংহপরিবারের শ্ৰীকণ্ঠ সিংহ মহাশয় ? –পাণ্ডুলিপি —“সত্যেন্দ্ৰপ্ৰসন্ন সিংহ মহাশয়ের জ্যেষ্ঠতাত ।” Sዘ$br