পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উপরে বা তলায় একটা সজীব প্ৰাণী দেখিলেই তখনই তাহকে নিকাশ করিয়া কেলিবার জন্য শিকারির হাত জন্বিত । অল্পকালের জন্য আমাদের একজন মাস্টার ছিলেন, তাহার এই আমোদ ছিল । আমি তখন নিতান্ত বালক ছিলাম, কিন্তু আমাকেও তিনি ছড়িতেন নয়। অথচ পৃষ্ঠাহীর বিদ্যা সামানই ছিল--তিনি যে সত্যনুসন্ধানের উৎসাহে সকল মতামত আলোচনা করিয়া একটা পন্থা গ্রহণ করিয়ছিলেন তাহাও নহে; তিনি আর-একজন ব্যক্তির মুখ হইতে তর্কগুলি সংগ্ৰহ করিয়ছিলেন। আমি প্ৰাণপণে র্তাহার সঙ্গে লড়াই করিতাম, কিন্তু আমি তঁহার নিতান্ত অসমকক্ষ প্রতিপক্ষ ছিলাম বলিয়া আমাকে প্রায়ই বড়ো দুঃখ পাইতে হইত। এক-একদিন এত রাগ হইত। যে কঁদিতে ইচ্ছা করিত । 帖 আর-এক দল ছিলেন ঠাহীরা ধর্মকে বিশ্বাস করিতেন না, সত্যোগ করতেন। এইজন্য ধর্মকে উপলক্ষ করিয়া যত কলাকৌশল, যতপ্রকার শব্দগন্ধরপরসের আয়োজন আছে, তাহকে ভোগীর মতো আশ্রয় করিয়া তাহারা আবিষ্ট হইয়া থাকিতে ভালোবাসিতেন ; ভক্তিই তাহদের বিলাস । এই উভয় দলেই সংশয়বাদ ও নাস্তিকতা সত্যসন্ধানের তপস্যাজাত ছিল না ; তাহ প্ৰধানত আবেগের উত্তেজনা ছিল । যদিও এই ধর্মবিদ্রোহ আমাকে পীড়া দিত, তথাপি ইহা যে আমাকে একেবারে অধিকার করে নাই তাহা নহে। যৌবনের প্রারম্ভে বুদ্ধির ঔদ্ধত্যের সঙ্গে এই বিদ্রোহিতা আমার মনেও যোগ দিয়াছিল। আমাদের পরিবারে যে-ধর্মসাধনা ছিল আমার সঙ্গে তাহার কোনো সংস্রব ছিল না- আমি তাহকে গ্ৰহণ করি নাই । আমি কেবল আমার হৃদয়াবেগের চুলাতে হাপর করিয়া করিয়া মন্ত একটা আগুন জ্বালাইতেছিলাম। সে কেবলই অগ্নিপূজা ; সে কেবলই আহুতি দিয়া শিখাকেই বাড়াইয়া তোলা ; তাহার আর-কোনো লক্ষ্য ছিল না । ইহার কোনো লক্ষ্য নাই বলিয়াই ইহার কোনো পরিমাণ নাই ; ইহাকে যত বাড়ানো যায় তত বাড়ানোই წასმi | যেমন ধর্ম সম্বন্ধে তেমনি নিজের হৃদয়াবেগ সম্বন্ধেও কোনো সত্য থাকিবার কোনো প্রয়োজন ছিল না, উত্তেজনা থাকিলেই যথেষ্ট । তখনকার কবির’ একটি লোক মনে পড়ে আমার হৃদয় আমরি হৃদয় বেচিনি তো তাহাকাহারও কাছে, ভাঙাচোরা হোক, যা হোক তা হোক, আমার হৃদয় আমার আছে। সত্যের দিক দিয়া হৃদয়ের কোনো বালাই নাই, তাহার পক্ষে ভাণ্ডিয়া যাওয়া বা অন্য কোনোপ্রকার দুর্ঘটনা নিতান্তই অনাবশ্যক ; দুঃখবৈরাগ্যের সত্যটা স্পাহনীয় নয়, কিন্তু শুদ্ধমাত্র তাহার বাকিটুকু উপভোগের সামগ্ৰী- এইজন্য কাব্যে সেই জিনিসটার কারবার জমিয়া উঠিয়ছিল- ইহাই দেবতাকে বাদ দিয়া দেবোপাসনার রসাটুকু ছিকিয়া লণ্ডয়া। আজও আমাদের দেশে এ বালাই ঘুচে নাই। সেইজন্য আজও আমরা ধর্মকে যেখানে সত্যে প্রতিষ্ঠিত করিতে না পারি সেখানে ভাবুকত দিয়া আর্টের শ্রেণীভুক্ত করিয়া তাহার সমর্থনা করি। সেইজন্যই বহুল পরিমাণে আমাদের দেশহিতৈবিতা দেশের যথাৰ্থ সেবা নহে, কিন্তু দেশ সম্বন্ধে হৃদয়ের মধ্যে একটা ভাব অনুভব করার আয়োজন করা।