পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

to রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রকৃতির প্রতিশোধ এই কারোয়ারে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ” নামক নাট্যকাব্যটি লিখিয়ছিলাম। এই কাব্যের নায়ক সন্ন্যাসী সমস্ত স্নেহবন্ধন মায়াবন্ধন ছিন্ন করিয়া, প্রকৃতির উপরে জয়ী হইয়া, একান্ত বিশুদ্ধভাবে অনন্তকে উপলব্ধি করিতে চাহিয়াছিল। অনন্ত যেন সবকিছুর বাহিরে। অবশেষে একটি বালিকা তাহকে স্নেহপাশে বদ্ধ করিয়া আনন্তের ধ্যান হইতে সংসারের মধ্যে ফিরাইয়া আনে। যখন ফিরিয়া আসিল তখন সন্ন্যাসী ইহাই দেখিলক্ষুদ্রকে লইয়াই বৃহৎ সীমাকে লইয়াই অসীম, প্রেমকে লইয়াই মুক্তি। প্রেমের আলো যখনই পাই তখনই যেখানে চোখে মেলি সেখানেই দেখি, সীমার মধ্যেও সীমা নাই। প্রকৃতির সৌন্দর্য যে কেবলমাত্র আমারই মনের মরীচিকা নহে, তাহার মধ্যে যে অসীমের আনন্দই প্রকাশ পাইতেছে এবং সেইজন্যই যে এই সৌন্দর্ষের কাছে আমরা আপনাকে ভুলিয়া যাই, এই কথাটা নিশ্চয় করিয়া বুঝাবাইবার জায়গা ছিল বটে। সেইকারোয়ারের সমুদ্রবেলা। বাহিরের প্রকৃতিতে যেখানে নিয়মের ইন্দ্ৰজালে অসীম আপনাকে প্রকাশ করিতেছেন সেখানে সেই নিয়মের বাধাবিধির মধ্যে আমরা অসীমকে না দেখিতে পারি, কিন্তু যেখানে সৌন্দর্য ও গ্ৰীতির সম্পর্কে হৃদয় একেবারে অব্যবহিতভাবে ক্ষুদ্রের মধ্যেও সেই ভূমীর সম্পর্শ লাভ করে, সেখানে সেই প্ৰত্যক্ষাবোধের কাছে কোনো তর্ক খাটিবে কী করিয়া ? এই হৃদয়ের পথ দিয়াই প্রকৃতি সন্ন্যাসীকে আপনার সীমা-সিংহাসনের অধিরাজ অসীমের খসদরবারে লইয়া গিয়াছিলেন। প্রকৃতির প্রতিশোধ -এর মধ্যে এক দিকে যতসব পথের লোক, যতসব গ্রামের নরনারী- তাহারা আপনাদের ঘর-গড়া প্রত্যাহিক তুচ্ছতার মধ্যে অচেতনভাবে দিন কাটাইয়া দিতেছে ; আর-এক দিকে সন্ন্যাসী, সে আপনার ঘর-গড়া এক অসীমের মধ্যে কোনোমতে আপনাকে ও সমন্ত-কিছুকে বিলুপ্ত করিয়া দিবার চেষ্টা করিতেছে। প্রেমের সেতুতে যখন এই দুই পক্ষের ভেদ ঘুচিল, গৃহীর সঙ্গে সন্ন্যাসীর যখন মিলন ঘটিল, তখনই সীমায় অসীমে মিলিত হইয়া সীমার মিথ্যা তুচ্ছতা ও অসীমের মিথ্যা শূন্যতা দূর হইয়া গেল। আমার নিজের প্রথম জীবনে আমি যেমন একদিন আমার অন্তরের একটা অনিৰ্দেশ্যতাময় অন্ধকার গুহার মধ্যে প্রবেশ করিয়া বাহিরের সহজ অধিকারটি হারাইয়া বসিয়ছিলাম, অবশেষে সেই বাহির হইতেই একটি মনোহর আলোক হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিয়া আমাকে প্রকৃতির সঙ্গে পরিপূর্ণ করিয়া মিলাইয়া দিল- এই প্রকৃতির প্রতিশোধ -এও সেই ইতিহাসটিই একটু অন্যরকম করিয়া লিখিত হইয়াছে। পরবতী আমার সমস্ত কাব্যরচনার ইহাও একটা ভূমিকা। আমার তো মনে হয়, আমার কাব্যরচনার এই একটিমাত্র পালা। সে পালার নাম দেওয়া যাইতে পারে, সীমার মধ্যেই অসীমের সহিত মিলন-সাধনের পালা । এই ভাবটাকেই আমার শেষ বয়সের একটি কবিতার ছত্ৰে প্ৰকাশ করিয়ছিলাম বৈরাগসাধনে মুক্তি সে আমার নয়। তখনো আলোচনা নাম দিয়া যে ছোটো ছোটো গদ্যপ্ৰবন্ধ বাহির করিয়ছিলাম তাহার গোড়ার দিকেই প্রকৃতির প্রতিশোধ -এর ভিতরকার ভাবটির একটি তত্ত্বব্যাখ্যা লিখিতে চেষ্টা করিয়ছিলাম।” সীমা যে সীমাবদ্ধ নহে, তাহা যে অতল স্পর্শ গভীরতাকে এক কণার মধ্যে সংহত করিয়া দেখাইতেছে, ইহা লইয়া আলোচনা করা হইয়াছে। তত্ত্বহিসাবে সে ব্যাখ্যার কোনো মূল্য আছে কি না, এবং কাব্যহিসাবে প্রকৃতির প্রতিশোধ -এর স্থান কী তাহা জানি না- কিন্তু আজ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, এই একটিমাত্র আইডিয়া অলক্ষ্যভাবে নানা বেশে আজ পর্যন্ত আমার সমন্ত রচনাকে অধিকার করিয়া আসিয়াছে। কারোয়ার হইতে ফিরিবার সময় জাহাজে প্রকৃতির প্রতিশোধ-এর কয়েকটি গান লিখিয়ছিলাম। বড়ো একটি আনন্দের সঙ্গে প্রথম গানটি জাহাজের ডেকে বসিয়া সুর দিয়া-দিয়া গাহিতে-গাঁহিতে রচনা ১ রচনা ১২৯০, গ্রন্থপ্রকাশ ১২৯১ (১৮৮৫)। রবীন্দ্ররচনাবলী ১ ২ ৩০ সংখ্যক কবিতা, নৈবেদ্য (১৩০৮), রবীন্দ্ররচনাবলী ৮ (সুলত ০) ● ब' or ञ्, नच १९७०; क्री-नाणीज ९