পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(So রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার উপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম তাহা । বড়ো মনোহর । সেই সময়ে আবার কিছুকালের জন্য আমার একটা সৃটিছাড়া রকমের মনের ভাব ও বাহিরের আচরণ দেখা দিয়াছিল। সংসারের লোকলৌকিকতাকে নিরতিশয় সত্য পদার্থের মতো মনে করিয়া তাহাকে সদাসর্বদা মানিয়া চলিতে আমার হাসি পাইত। সে সমন্ত যেন আমার গায়েই ঠেকিত না । কে আমাকে কী মনে করিবে, কিছুদিন এ-দায় আমার মনে একেবারেই ছিলনা। ধুতির উপর গায়ে কেবল একটা মোটা চাদর এবং পায়ে একজোড়া চটি পরিয়া কতদিন থাকারের” বাড়িতে বই কিনিতে গিয়াছি। আহারের ব্যবস্থাটাও অনেক অংশে খাপছাড়া ছিল। কিছুকাল ধরিয়া আমার শয়ন ছিল বৃষ্টি বাদল শীতেও তেতলায় বাহিরের বারান্দায় ; সেখানে আকাশের তারার সঙ্গে আমার চোখোচে্যুখি হইতে পারিত এবং ভোরের আলোর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের বিলম্ব হইত না । এ-সমস্ত যে বৈরাগ্যের কৃচ্ছসাধন তাহা একেবারেইনহে। এ যেন আমার একটা ছুটির পালা, সংসারের বেত-হাতে গুরুমহাশয়কে যখন নিতান্ত একটা ফাকি বলিয়া মনে হইল তখন পাঠশালার প্রত্যেক ছোটাে ছোটাে শাসনও এড়াইয়া মুক্তির আস্বাদনে প্রবৃত্ত হইলাম। একদিন সকালে ঘুম হইতে জাগিয়াই যদি দেখি পৃথিবীর ভারাকর্ষণটা একেবারে অর্ধেক কমিয়া গিয়াছে, তাহা হইলেকি আর সরকারি রাস্তা বাহিয়া সাবধানে চলিতে ইচ্ছা করে। নিশ্চয়ই তাহা হইলে হ্যারিসন রোডের চারতলা-পাচতলা বাড়িগুলা বিনা কারণেই লাফ দিয়া ডিঙাইয়া চলি এবং ময়দানে হাওয়া খাইবার সময় যদি সামনে অষ্ট্রলনি মনুমেন্টুটা আসিয়া পড়ে তাহা হইলে ঐটুকুখনি পাশ কাটাইতেও প্রবৃত্তি হয় না, ধা করিয়া তাহাকে লঙ্ঘন করিয়া পার হইয়া যাই। আমারও সেই দশা ঘটিয়াছিল- পায়ের নীচে হইতে জীবনের টান কমিয়া যাইতেই আমি বাধা রাস্তা একেবারে ছাড়িয়া দিবার জো করিয়াছিলাম। বাড়ির ছাদে একলা গভীর অন্ধকারে মৃত্যুরাজ্যের কোনো একটা চুড়ার উপরকার একটা ধ্বজপতাকা, তাহার কালো পাথরের তোরণদ্বারের উপরে আঁক-পাড়া কোনো-একটা অক্ষর কিংবা একটা চিহ্ন দেখিবার জন্য আমি যেন সমস্ত রাত্রিটার উপর অন্ধের মতো দুইহাত বুলাইয়া ফিরিতাম। আবার, সকালবেলায় যখন আমার সেই বাহিরের পাতা বিছানার উপরে ভোরের আলো আসিয়া পড়িত তখন চোখ মেলিয়াই দেখিতাম, আমার মনের চারিদিকের আবরণ যেন স্বচ্ছা হইয়া আসিয়াছে; কুয়াশা কটিয়া গেলে পৃথিবীর নদী গিরি অরণ্য যেমন ঝলমল করিয়া ওঠে, জীবনলোকের প্রসারিত ছবিখনি আমার চোখে তেমনি শিশিরসিক্ত নবীন ও সুন্দর করিয়া দেখা দিয়াছে। বর্ষা ও শরৎ এক-এক বৎসরে বিশেষ এক-একটা গ্রহ রাজার পদ ও মীর পদ লাভ করে, পঞ্জিকার আরম্ভেই পশুপতি ও হৈমাবতীর নিভৃত আলাপে তাহার সংবাদ পাই। তেমনি দেখিতেছি, জীবনের এক-এক পর্যায়ে এক-একটি ঋতু বিশেষভাবে আধিপত্য গ্ৰহণ করিয়া থাকে। বাল্যকালের দিকে যখন তাকাইয়া দেখি তখন সকলের চেয়ে স্পষ্ট করিয়া মনে পড়ে তখনকার বর্ষার দিনগুলি। বাতাসের বেগে জলের ছাটে বারান্দা একেবারে তরিতরকারি বাজার করিয়া ভিজিতে ভিজিতে জলকানা ভাঙিয়া আসিতেছে, আমি বিনা কারণে দীর্ঘ বারান্দায় প্রবল আনন্দে চুটিয়া বেড়াইতেছি। আর মনে পড়ে, ইস্কুলে গিয়াছি; দরমােয়-ঘেরা দালানে আমাদের ক্লাস বসিয়াছে; অপরান্ত্রে ঘনঘোর মেঘের ভূপে ভূপে আকাশ ছাইয়া গিয়াছে; দেখিতে দেখিতে - Thacker Spink & Co. ২। ভুবৰ্যর চিঠি, বালক, শ্রাবণ ১২১২। স্ত্ৰ গ্ৰহপরিচয় ১৭