পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

r SA আসিল উহার ছোটাে মুঠর মধ্যে একখানি অদৃশ্য পরিচয়পত্র ছিল। সকলের চেয়ে যিনি বড়ো তিনিই । নিজের নাম সই করা একখানি চিঠি ইহার হাতে দিয়াছিলেন। তাহাতে লেখা ছিল, এই লোকটি আমার নিতান্ত পরিচিত, তােমরা যদি ইহাকে যত্ন কর তবে আমি খুশি হইব । ) x তাহার পরে কাহার সাধ্য ইহার দ্বার রোধ করে। সমস্ত পৃথিবী তখনই বলিয়া উঠিল, এসো, এসো, আমি তোমাকে বুকে করিয়া রাখিব-দূর আকাশের তারাগুলি পর্যন্ত ইহাকে হাসিয়া অভ্যর্থনা করিল-বলিল, তুমি আমাদেরই একজন। বসন্তের ফুল বলিল, আমি তোমার জন্য ফলের আয়োজন করিতেছি; বর্ষার মেঘ বলিল, তোমার জন্য অভিষেকের জল নির্মল করিয়া রাখিলাম। এমনি করিয়া জন্মের আরম্ভেই প্রকৃতির বিশ্বদরবারের দরজা খুলিয়া গেল। মা-বাপের যে স্নেহ সেও প্রকৃতি প্রস্তুত করিয়ারাখিয়াছে। শিশুরাকান্না যেমনি আপনাকে ঘোষণা করিল অমনি সেইমুহূর্তেই জলস্থল । আকাশ সেই মুহুর্তেই মা-বাপের প্রাণ সাড়া দিল, তাহাকে অপেক্ষা করিতে হইল না। কিন্তু আরো একটি জন্ম ইহার বাকি আছে, এবার ইহাকে মানবসমাজের মধ্যে জন্ম লইতে হইবে। নামকরণের দিনই সেই জন্মের দিন। একদিন রূপের দেহ ধরিয়া এই কন্যা প্রকৃতির ক্ষেত্রে আসিয়াছিল, আজ নামের দেহ ধরিয়া এই কন্যাসমাজের ক্ষেত্রে প্রথম পদাৰ্পণ করিল। জন্মমাত্রে পিতামাতা এই শিশুকে স্বীকার করিয়া লইয়াছে, কিন্তু এ যদি কেবলই ইহার পিতামাতারই হইত। তবে ইহার আর নামের দরকার হইত না, তবে ইহাকে নিত্য নূতন নূতন নামে ডাকিলেও কাহারও ক্ষতিবৃদ্ধি ছিলনা। কিন্তু এ মেয়েট নাকি শুধু পিতামাতার নহে, এ নাকি সমস্ত মানবসমাজের, সমস্ত মানুষের জ্ঞান প্রেম কর্মের বিপুল ভাণ্ডার নাকি ইহার জন্য প্রস্তুত আছে, সেইজন্য মানবসমাজ ইহাকে একটি নামদেহ দিয়া আপনার করিয়া লইতে চায়। মানুষের যে শ্ৰেষ্ঠরূপ যে মঙ্গলরাপ তাহা এই নামদেহটির দ্বারাই আপনাকে চিহ্নিত করে। এই নামকরণের মধ্যে সমস্ত মানবসমাজের একটি আশা আছে, একটি আশীৰ্বাদ আছে-এই নামটি যেন নষ্ট না হয়, স্নান না হয়, এই নামটি যেন ধন্য হয়, এই নামটি যেন মধুর্যে ও পবিত্রতায় মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অমরতা লাভ করে। যখন ইহার রূপের দেহটি একদিন বিদায় লইবে তখন ইহার নামের দেহটি মানবসমাজের মর্মস্থানটিতে যেন উজ্জ্বল হইয়া বিরাজ করে। আমরা সকলে মিলিয়া এই কন্যাটির নাম দিয়াছি, অমিতা। অমিতা বলিতে বুঝায় এই যে, যাহার সীমা নাই। এই নামটি তো ব্যর্থনহে। আমরা যেখানে মানুষের সীমা দেখিতেছি। সেইখানেই তো তাহার সীমা নাই। এই যে কালভাষিণী কন্যাটি জানেনা যে আমরা ইহাকে লইয়াই আনন্দ করিতেছি, জানেনা বাহিরে কী ঘটতেছে, জানেনা ইহার নিজের মধ্যে কী আছে- এই অপরিস্ফুটিতার মধ্যেই তো ইহার সীমা নহে। এই কন্যাটি যখন একদিন রমণীরূপে বিকশিত হইয়া উঠিবে তখনই কি এ আপনার চরমকে লাভ করবে ? তখনাে এই মেয়েটি নিজেকে যাহা বলিয়া জানিবে এ কি তাহার চেয়েও অনেক বড়ো নহে! মানুষের মধ্যে এই যে একটি অপরিমেয়ত আছে যাহা তাহার সীমাকে কেবলই অতিক্রমকরিয়া চলিয়ছে তাঁহাই কি তাহার । সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ পরিচয় নহে? মানুষ যেদিন নিজের মধ্যে আপনার এই সত্য পরিচয়টি জানিতে পারে সেইদিনই সে ক্ষুদ্রতার জাল ছেদন করিবার শক্তি পায়, সেইদিনই সে উপস্থিত স্বার্থক লক্ষ্য বলিয়া স্বীকার করে না, সেই দিনই সে চিরন্তন মঙ্গলকেই আপনার বলিয়া বরণ করিয়া লয়। যে মহাপুরুষেরা মানুষকে । সত্য করিয়া চিনিয়াছেন তাহারা তো আমাদের মত বলিয়া জানেন না, তাহারা আমাদের ডাক দিয়া বলেন, আমরা অমিতা নামে সেই অমৃতের পুত্ৰীকেই আমাদের সমাজে আহ্বান করিলাম। এই নামটি ইহাকে আপন মানবজন্মের মহত্ব চিরদিন স্মরণ করাইয়া দিক আমরা ইহাকে এই আশীৰ্বাদ করি। - আমাদের দেশে নামকরণের সঙ্গে আর-একটি কাজ আছে সেটি অন্নপ্রাশন। দুটির মধ্যে গভীর একটি যোগ রহিয়াছে। শিশু যেদিন একমাত্র মায়ের কোল অধিকার করিয়া ছিল সেদিন তাহার অন্ন ছিল । মাতৃস্তন্য। সে অন্ন কাহাকেও প্রস্তুত করিতে হয় নাই- সে একেবারে তাহার একলার জিনিস, তাহাতে আর কাহারও অংশ ছিল না। আজ সে নামদেহ ধরিয়া মানুষের সমাজে আসিল তাই আজ তাহার মুখে মানবসাধারণের অন্নকশাটি উঠিল। সমস্ত পৃথিবীতে সমস্ত মানুষের পাতে পাতে যে অন্ত্রের পরিবেশন