পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

EOR রবীন্দ্র রচনাবলী একেবারে কাটিয়া বসিয়া যায়। সেইরূপ ধর্মের সংস্কারকে সংকীর্ণ করিলে তাহা চিরশৃঙ্খলের মতো মানুষকে চাপিয়া ধরে- মানুষের সমন্ত আয়তন যখন বাড়িতেছে তখন সেই ধর্ম আর বাড়ে না, রক্তচলাচলকে বন্ধ । করিয়া অঙ্গকে সে কৃশ করিয়াই রাখিয়া দেয়, মৃত্যু পর্যন্ত তাহার হাত হইতে নিস্তার পাওয়াই কঠিন হয়। সেই অতি কঠিন সংকীর্ণ ধর্মের প্রাচীন বন্ধনকে রামমোহন রায় যে কোনোমতেই আপনার আশ্রয় বলিয়া কল্পনা করিতে পারেন নাই তাহার কারণ এই যে, তিনি সহজেই বুঝিয়েছিলেন, যে সত্যের ক্ষুধায় মানুষ ধর্মকে প্রার্থনা করে সে সত্য ব্যক্তিগত নহে, জাতিগত নহে, তাহা সৰ্বৰ্গত। তিনি বাল্যকাল হইতেই অনুভব করিয়াছিলেন যে, যে দেবতা সর্বদেশে সৰ্বকালে সকল মানুষের দেবতা না হইতে পারেন, অর্থাৎ যিনি আমার কল্পনাকে তৃপ্ত করেন অন্যেরকল্পনাকে বাধা দেন, যিনি আমার অভ্যাসকে আকর্ষণ করেন অন্যের অভ্যাসকে পীড়িত করেন তিনি আমারও দেবতা হইতে পারেন না, কারণ সকল মানুষের সঙ্গে যোগ কোনোখানে বিচ্ছিন্ন করিয়া মানুষের পক্ষে পূর্ণ সত্য হওয়া একেবারেই সম্ভব হয় না এবং এই পূর্ণ সত্যই ধর্মের সত্য। আমাদের একটি পরম সৌভাগ্য এই ছিল যে, মানুষের শ্ৰেষ্ঠ ধর্মের মহােচ্চ আদর্শ একদিকে আমাদের দেশে যেমন বাধাগ্ৰস্ত হইয়াছিল। তেমনি আর-একদিকে তাহাকে উপলব্ধি করিবার সুযোগ আমাদের দেশে যেমন সহজ হইয়াছিল জগতের আর কোথাও তেমন ছিল না। একদিন আমাদের দেশে সাধকেরা ব্ৰহ্মকে। যেমন আশ্চর্য উদার করিয়া দেখিয়াছিলেন এমন আর কোনাে দেশেই দেখে নাই। তঁহাদের সেই ব্ৰহ্মোপলব্ধি একেবারে মধ্যাহ্নগগনের সূর্যের মতো অত্মজ্বল হইয়া প্রকাশ পাইয়াছিল, দেশকালপত্রগত সংস্কারের লেশমাত্র বাস্প তাহাকে কোথাও স্পর্শ করে নাই। সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্ৰহ্ম যিনি, তাহারই মধ্যে মানবচিত্তের এরূপ পরিপূর্ণ আনন্দময় মুক্তির বার্তা এমন সুগভীর রহস্যময় বাণীতে অথচ এমন শিশুর মতো অকৃত্রিম সরল ভাষায় উপনিষদ ছাড়া আর কোথায় ব্যক্ত হইয়াছে ? আজমানুষের বিজ্ঞান তত্ত্বজ্ঞান যতদূরই অগ্রসর হইতেছে, সেই সনাতন ব্ৰহ্মোপলব্ধির মধ্যে তাহার অন্তরে বাহিরে কোনো বাধাই পাইতেছে না। তাহা মানুষের সমস্ত জ্ঞানভক্তিকর্মকে পূর্ণ সামঞ্জস্যের মধ্যে গ্ৰহণ করিতে পারে, কোথাও তাঁহাকে পীড়িত করে না, সমস্তকেই সে উত্তরোত্তর ভূমীর দিকেই আকর্ষণ করিতে থাকে, কোথাও তাঁহাকে কোনো সাময়িক সংকোচের দোহাই দিয়া মাথা হেঁট করিতে বলে না । কিন্তু এই ব্ৰহ্ম তো কেবল জ্ঞানের ব্ৰহ্ম নহেন-রাসো বৈাসঃ- তিনি আনন্দরূপং অমৃতরূপং । ব্ৰহ্মই যে রসস্বরূপ, এবং- এযোস্য পরম আনন্দঃ- ইনিই আত্মার পরম আনন্দ, আমাদের দেশের সেই চিরলব্ধ সত্যটিকে যদি এই নূতন যুগে নৃতন করিয়া সপ্রমাণ করিতে না পারি। তবে ব্ৰহ্মজ্ঞানকে তো আমরা ধর্ম বলিয়া মানুষের হাতে দিতে পারিব না- ব্ৰহ্মজ্ঞানী তো ব্ৰহ্মের ভক্ত নহেন। রস ছাড়া তো আর কিছুই মিলাইতে পারে না, ভক্তি ছাড়া তো আর কিছুই বঁধিতে পারে না। জীবনে যখন আত্মবিরোধ ঘটে, যখন হৃদয়ের এক তারের সঙ্গে আর-এক তারের অসামঞ্জস্যের বেসুর কর্কশ হইয়া উঠে তখন কেবলমাত্র বুঝাইয়া BB DBBD KE DD DOSYS gBBB uDSDD BBB DD DS ব্ৰহ্ম যে সত্যস্বরূপ তাহা যেমন বিশ্বাসত্যের মধ্যে জানি, তিনি যে জ্ঞানস্বরূপ তাহা যেমন আত্মজ্ঞানের মধ্যে বুঝিতে পারি, তেমনি তিনি যে রসম্বরপ তাহা কেবলমাত্র ভক্তের আনন্দের মধ্যেই দেখিতে পাই। ব্ৰাহ্মধর্মের ইতিহাসে সে দেখা আমরা দেখিয়ছি। এবং সে দেখা আমাদিগকে দেখাইয়া চলিতে হইবে । ব্ৰাহ্মসমাজে আমরা একদিন দেখিয়ছি। ঐশ্বর্যের আড়ম্বরের মধ্যে, পূজা-অৰ্চনা ক্রিয়া-কর্মের মহাসমারোহের মাঝখানে বিলাসলালিত তরুণ যুবকের মন ব্রহ্মের জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিয়ছিল। তাহার পরে দেখিয়ছি সেই ব্ৰহ্মের আনন্দেই সাংসারিক ক্ষতি-বিপদকে তিনি ভুক্ষেপ করেন নাই, আত্মীয়স্বজনের বিচ্ছেদ ও সমাজের বিরোধকে ভয় করেন নাই; দেখিয়াছি চিরদিনই তিনি তঁহার জীবনের চিরকরণীয় দেবতার এই অপরাপ বিশ্বমন্দিরের প্রাঙ্গণতলে তঁহার মন্তককে নত করিয়া রাখিয়াছিলেন, এবং এমনি করিয়াই তো আমাদের নবযুগের ধর্মের রসম্বরূপকে আমরা নিশ্চিত সত্য করিয়া দেখিতেছি। কোনো বাহমূর্তিত নহে, কোনো ক্ষশকালীন কল্পনায় নহে-একেবারে মানুষের অন্তরতম আত্মার মধ্যেই