পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সঞ্চয় । 设°@ পুলকিত করিয়া তুলিতেছে, কথা কহিবার প্রয়োজন যে কী তাহা সে .... بعد ۔۔"" কিছুই জানে না। কিন্তু কথা কহার মধ্যে যে পূর্ণতা, সেই পূর্ণতা দূর হইতেই তাহাকে আনন্দ আহবান পঠাইতেছে, সেই আনন্দে সে বারবার নানা শব্দ উচ্চারণ করিয়া কিছুতেই ক্লান্ত হইতেছে না। তেমনি করিয়াই আমাদের এই ছোটাে শরীরটির দিকে বিরাট বিশ্ব-শরীরের একটি আনন্দের টান কাজ । করিতেছে। ইহা পূর্ণতার আকর্ষণ, সেইজন্য যেখানে আমাদের কোনাে প্রয়ােজন নাই সেখানেও আমাদের শক্তি চুটিয়া যাইতে চায়। গ্রহে চন্ত্রে তারায় কী আছে তাহা দেখিবার জন্য মানুষ রাত্রির পর রাত্রি জাগিতে শ্ৰান্ত হয় না। যেখানে তাহার প্রয়োজনক্ষেত্র সেখান হইতে অনেক দূরে মানুষ আপনাব ইন্দ্ৰিয়বােধকে দূত পঠাইতেছে। যাহাকে সহজে দেখা যায় না। তাহাকে দেখিবার জন্য দূরবীন অণুবীক্ষণের শক্তি কেবলই সে বাড়াইয়া চলিয়ছে- এমনি করিয়া মানুষ নিজের চক্ষুকে বিশ্বব্যাপী করিয়া তুলিতেছে ; যেখানে সহজে যাওয়া যায় না। সেখানে যাইবার জন্য নব নবযানবাহনের কেবলইসেসৃষ্টি করিতেছে;এমনি করিয়া মানুষ আপনার হাত-পাকে বিশ্বে প্রসারিত করিবার চেষ্টা করিতেছে। জলস্থল আকাশের সঙ্গে আপনার যোগ অবারিত করিবার উদযোগ কত কাল হইতে চলিয়ছে। জলস্থল আকাশের পথ দিয়া সমস্ত জগৎ মানুষের চােখ কান হাত-পাকে কেবলই যে ডাক দিতেছে। বিরাটের এই নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য মানুষ পৃথিবীতে পদার্পণের পরমুহুর্ত হইতেই আজ পর্যন্ত কেবলই দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর, প্রশস্ত হইতে প্রশস্ততর করিয়া পথ তৈরি করিতে লাগিয়াছে। বিরাটরসেই নিমন্ত্রণ প্রয়োজনের নিমন্ত্ৰণ নহে,তাহা মিলনের নিমন্ত্রণ, আনন্দের নিমন্ত্রণ ;তাহা ক্ষুদ্র শরীরের সহিত বৃহৎ শরীরের পরিণয়ের নিমন্ত্রণ; এই পরিণয়েপ্রেমও আছে সংসারযাত্রাও আছে, আনন্দও আছে। প্রয়োজনও আছে; কিন্তু এই মিলনের মূলমন্ত্ৰ আনন্দেরই মন্ত্ৰ। - শুধু চােখ কান হাত পা লইয়া মানুষ নয়। তাহার একটা মানসিক কলেবর আছে। নানাপ্রকারের বৃত্তি প্রবৃত্তি সেই কলেবরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। এই সব মনের বৃত্তি লইয়া আপনার মনটিকে যে নিতান্তই কেবল আপনার করিয়া সকল হইতে তফাত করিয়া রাখিব তাহার জো নাই। ঐ বৃত্তিগুলাই আপনার বাহিরে ছুটিবার জন্য মনকে লইয়া কেবলই টানাটানি করিতেছে। মন একটি বৃহৎ মনােলোকের সঙ্গে যতদূর পারে পূর্ণরূপে মিলিতে চাহিতেছে। নহিলে তাহার স্নেহপ্রেম দয়ামায়া, এমনকি, ক্ৰোধ দ্বেষ লোভ হিংসারও কোনো অর্থই থাকে না। সকল মানুষের মন বলিয়া একটি খুব বড়ো মনের সঙ্গে সে আপনার ভালোরকম মিল করিতে চায়। সেইজন্য কত কাল হইতে সে যে কত রকমের পরিবরতন্ত্র সমাজতন্ত্র রাষ্ট্ৰতন্ত্র গড়িয়া তুলিতেছে তাহার ঠিকানা নাই। যেখানে বাধিয়া যায় সেখানে তাহাকে আবার ভাঙিয়া ফেলিতে হয়, গড়িয়া তুলিতে হয়, এইজনাই কত বিপ্লব কত রক্তপাতের মধ্য দিয়া তাহাকে পথ চলিতে হইয়াছে। বৃহৎ মনঃশরীরের সঙ্গে আপনার মনটিকে বেশ ভালোরকম করিয়া মিলাইয়া লইতে না পারিলে মানুষ বীচে না। যে পরিমাণে তাহার ভালোরকম করিয়া মিল ঘটে সেই পরিমাণেই তাহার পূর্ণতা। যে ব্যবস্থায় তাহার মিল অসম্পূর্ণ হয় ও কেবলই ভেদ ঘটতে থাকে সেই ব্যবস্থায় তাহার দুৰ্গতি। এখানেও প্রয়ােজনের প্রেরণা মূল প্রেরণা এবং সর্বোচ্চ প্রেরণা নহে। মানুষ পরিবারের বাহিরে প্রতিবেশী, প্রতিবেশীর বাহিরে দেশ, দেশের বাহিরে বিশ্বমানবসমাজের দিকে আপন চিত্তবিস্তারের যে চেষ্টা করিতেছে। এ তাহার প্রয়োজনের আপিসযাত্রা নহে, এ তাহার অভিসারযাত্রা। ছােটাে হৃদয়টির প্রতি বড়ো হৃদয়ের একটি ডাক আছে। সে ডাক এক মুহূর্ত থামিয়া নাই। সেই ডাক শুনিয়া আমাদের হৃদয় বাহির হইয়াছে সে খবরও আমরা সকল সময়ে জানিতে পারি না। রাত্রি অন্ধকার হইয়া আসে, ঝড়ের মেঘ ঘনাইয়া উঠে, বারবার পথহারাইয়া যায়, পাকাটিয়া গিয়া মাটির উপর রক্তচিহ্ন পড়িতে থাকে। তবু সে চলে ; পথের মাঝে মাঝে সে বসিয়া পড়ে বটে কিন্তু সেখানেই চিরকাল বসিয়া থাকিতে পারে না, আবায় উঠিয়া আবার তাহাকে অগ্রসর হইতে হয় । এই যে মানুষের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, নানা ইন্দ্ৰিয়বােধ, তাহার নানা বৃত্তিপ্রবৃত্তি, এ সমস্তই মানুষকে কেবলই বিচিত্রের মধ্যে বিস্তারের দিকে লইয়া চলিয়াছে। এই বিচিত্রের শেষ কোথায় ? এই বিস্তারের অন্ত কল্পনা করিব কোনখানে ? শুনিয়াছি সেকেন্দর শ একদিন জয়োৎসাহে উন্মত্ত হইয়া চিন্তা করিয়াছিলেন জিতিয়া । লাইবার জন্য দ্বিতীয় আর-একটা পৃথিবী তিনি পাইবেন কোথায় ? কিন্তু মানুষের চিত্তকে কোনোদিন এমন বিষম দুশ্চিন্তায় আসিয়া ঠেকিতে হইবে না যে, তাহার অধিকার বিস্তারের স্থান আর নাই। কোনোদিন সে