পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

eeu রবীন্দ্র-রচনাবলী বিমর্ষ হইয়া বলিবে না যে, সে তাহার ব্যাপ্তির শেষ সীমায় আসিয়া বেকার হইয়া পড়িয়ছে। কিন্তু মানুষের পক্ষে কেবলই কি এই গণনাহীন বৈচিত্র্যের মধ্যে বিরামহীন ব্যাপ্তিই আছে ? কোনােখনেই তাহার পৌঁছানো নাই ? অন্তহীন বহু কেবলই কি তাহাকে এক হইতে দুই দুই হইতে তিনের সিঁড়ি বাহিয়া লইয়া চলিবে- সে সিঁড়ি কোথাও যাইবার নাম করিবে না ? ? এ কখনো হইতেই পারে না । আমরা জগতে এই একটি কাণ্ড দেখি- গম্যস্থানকে আমরা পদে পদেই পাইতেছি। বস্তুত আমরা গামস্থানেই আসিয়া রহিয়াছি- আমরা গামস্থানের মধ্যেই চলিতেছি। অর্থাৎ যা আমরা পাইবার তা আমরা পাইয়া বসিয়াছি, এখন সেই পাওয়ারই পরিচয় চলিতেছে। যেন আমরা রাজবাড়িতে আসিয়ছি- কিন্তু কেবল আসিলেই তো হইল না- তাহার কত মহল কত ঐশ্বৰ্য কে তাহার গণনা করিতে পারে ? এখন তাই দেখিয়া দেখিয়া বেড়াইতেছি। এইজন্য একটু করিয়া যাহা দেখিতেছি। তাহাতেই সমস্ত রাজপ্রাসাদের পরিচয় পাইতেছি । ইহাকে তো পথে চলা বলে না। পথে কেবল আশা থাকে, আস্বাদন থাকে না। আবার যে পথ অনন্ত সেখানে আশাই বা থাকিবে কেমন করিয়া ? তাই আমি বলিতেছি আমাদের কেহু পথে বাহির করে নাই- আমরা ঘরেই আছি। সে ঘর এমন ঘর যে, তাহার বারান্ডায় ছাতে দালানে ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহাকে আর শেষ করিতে পারি না। অথচ সর্বত্রই তাহার শেষ ; সর্বত্রই তােহা ঘর, কোথাও তাহ পথ নহে। এ রাজবাড়ির এই তো কাণ্ড, ইহার কোথাও শেষ নাই। অথচ ইহার সর্বত্রই শেষ । ইহার মধ্যে সমাপ্তি এবং ব্যাপ্তি একেবারে গায়ে গায়ে লাগিয়া আছে। এইজন্য এখানে কোনোখানে আমরা বসিয়া থাকি না। অথচ প্রত্যেক পদেই আমরা আশ্রয় পাই। মাটি যুঁড়িয়া যখন অন্ধুর বাহির হইল তখন সেইখনেই আমাদের চােখ বিশ্রাম করিতে পারে। অন্ধুর যখন বড়ো গাছ হইল। তখন সেখানেও আমাদের মন দাড়াইয়া দেখে। গাছে যখন ফুল ধরে তখন ফুলেও আমাদের তৃপ্তি। ফুল হইতে যখন ফল জন্মে তখন তাহাতেও আমাদের লাভ। কোনাে জিনিস সম্পূর্ণ শেষ হইলে তবেই তাহার সম্বন্ধে আমরা পূর্ণতাকে পাইব আমাদের এমন দূরদৃষ্ট নহে- পূর্ণতাকে আমরা পর্বে পর্বে পাইয়াই চলিয়ছি। তাই বলিতেছিলাম ব্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই আমরা পরিসমাপ্তির স্বাদ পাইতে থাকি সেইজন্যই ব্যাপ্তি আনন্দময়- নহিলে তাহার মতো দুঃখকর আর কিছুই হইতে পারে না । ব্যাপ্তি এবং সমাপ্তি এই যে দুটি তত্ত্ব সর্বত্র একসঙ্গেই বিরাজ করিতেছে আমাদের মধ্যেও নিশ্চয় ইহার পরিচয় আছে। আমরাও নিশ্চয় আপনাকে উপলব্ধি করিবার জন্য অনন্ত জীবনের প্রান্তে পীে ছিবার দুরাশায় অপেক্ষা করিতেছি না। এ কথা বলিতেছি না যে, এখনো যখন আমার সমস্ত নিঃশেষে চুকিয়া বুকিয়া যায় নাই তখন আমি আপনাকে জানিতেছি না। বস্তুত আমার মধ্যে এক দিকে চলা, এবং আর-এক দিকে পৌছানো, এক দিকে বহু, আর-একদিকে এক, একসঙ্গেই রহিয়াছে, নহলে অস্তিত্বের মতো বিভীষিকা আর কিছুই থাকিত না। একদিকে আমার বিচিত্র শক্তি বাহিরের বিচিত্রের দিকে চলিয়ছে, আর-এক দিকে আমার আনন্দ ভিতরের একের দিকে পূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। এই যেখানে মানুষের আপনার আনন্দ- এইখানেই মানুষের পর্যাপ্তি, এইখানেই মানুষ বড়ো। এইখন হইতেই গতি লইয়া মানুষের সমস্ত শক্তি বাহিরে চলিয়াছে এবং বাহির হইতে পুনরায় তাহারা এইখানেই অর্ঘ্য বাহির হইতে যখন দেখি তখন বলি মানুষ নিশ্বাস লইয়াবীচিতেছে, মানুষ আহার করিয়াবীচিতেছে, রক্ত চলাচলে মানুষ বীচিয়া আছে। এমন করিয়া কত আর বলিব ? বলিতে গিয়া তালিকা শেষ হয় না। তখন দেখি শরীরের অণুতে অণুতে রসে রক্তে অস্থিমজ্জামায়ুপেশীতে ফৰ্দ কেবল বাড়িয়া চলিতেই থাকে। তাহার পরে যখন প্ৰাণের হিসােব শেষ পর্যন্ত মিলাইতে গিয়া আলোকে উত্তাপে বাতাসে জলে মাটিতে আসিয়া পীেছাই, যখন প্রকৃত বৈজ্ঞানিক ও রাসায়নিক শক্তিরহস্যের মধ্যে গিয়া উপস্থিত হই, তখন একেবারে হাল এমন করিয়া অন্তহীনতার খাতায় কেবলই পাতা উলটাইয়া শ্ৰান্ত হইয়া মরিতে হয়। কিন্তু বাহির হইতে