পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(O পাইব কাহার কাছে ? একরূপ অদ্ভূত তর্ক আমাদের মুখেই শোনা যায় যে, যাহারা তামসিক প্রকৃতির লোক, মদমাংস যাহারা খাইবেই এবং পাশবতা যাহাদের স্বভাবসিদ্ধ, ধর্মের সম্মতি-দ্বারা যদি তাহদের পাশাবতাকে নির্দিষ্টপরিমাণে স্বীকার করা যায়- যদি বলা যায় এইরূপ বিশেষ ভাবে মদমাংস খাওয়া ও চরিত্রকে কলুষিত করা তোমাদের পক্ষে ধর্ম, তবে তাহাতে দোষ নাই, বরং ভালেই। এরাপ তর্কের সীমা যে কোনখানে তাহা ভাবিয়াই পাওয়া যায় না। মানুষের মধ্যে এমনতরোস্বভাব পাপিষ্ঠ অমানুষদেখা যায় নরহত্যায় যাহারা আনন্দ বোধ করে । এই শ্রেণীর লোকের জন্য ঠগিধর্মকেই ধর্ম বলিয়া বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া উচিত এ কথাও বােধ হয় আমাদের মুখে বাধিবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ঠিক নিজের গলাটা তাহাদের ফাসের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত না হয়। ধর্ম সম্বন্ধে সত্য সম্বন্ধে মানুষের উচ্চাধিকার নিম্নাধিকার একবার কোথাও স্বীকার করিতে আরম্ভ করিলেই মানুষ যে-মহাতী লইয়া জীবনসমুদ্রে পাড়ি দিতেছে তাহাকে টুকরা টুকরা করিয়া ভাঙিয়া ছোটাে ছােটাে ভেলা তৈরি করা হয়- তাহাতে মহাসমুদ্রের যাত্রা আর চলে না, তীরের কাছে থাকিয়া হাঁটুজলে । খেলা করা চলে মাত্র। কিন্তু যাহারা কেবল খেলিবেই, কোনােদিন যাত্রা করিবেই না, তাহারা খড়কুটা যাহা খুশি লইয়া আপনার খেলনা তৈরি করুক-না- তাহাদের জড়তার খাতিরে অমূল্য ধর্মতরীকে টুকরা করিয়াই কি চিরদিনের মতো সর্বনাশ ঘটাইতে হইবে ? : ; এ কথা আবার বলিতেছি, ধর্ম মানুষের পূর্ণ শক্তির অকুষ্ঠিত বাণী, তাহার মধ্যে কোনাে দ্বিধা নাই। সে মানুষকে মূঢ় বলিয়া স্বীকার করে না, দুর্বল বলিয়া অবজ্ঞা করে না। সেই তো মানুষকে ডাক দিয়া বলিতেছে, তুমি অজয়, তুমি অশোক, তুমি অভয়, তুমি অমৃত । সেই ধর্মের বলেই মানুষ যাহা পারে নাই তাহা পারিতেছে, যাহা হইয়া উঠিবে বলিয়া কোনোদিন স্বপ্নেও মনে করে নাই একদিন তাঁহাই হইয়া উঠিতেছে। কিন্তু এই ধর্মের মুখ দিয়াই মানুষ যদি মানুষকে এমন কথা কেবলই বলাইতে থাকে যে, “তুমি মূঢ়, তুমি বুঝিবে না, তবে তাহার মুঢ়তা ঘুচাইবে কে, যদি বলায় “তুমি অক্ষম, তুমি পরিবে না, তবে তাহাকে শক্তি দান করে জগতে এমন সাধ্য আর কাহার আছে ? আমাদের দেশে বহুকাল হইতে তাহাঁই ঘটিয়াছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ লোককেই আমাদের । ধর্মশাসন স্বয়ং বলিয়া আসিয়াছে পূর্ণ সত্যে তোমার অধিকার নাই; অসম্পূর্ণই তুমি সন্তুষ্ট হইয়া থাকে। কতশত লোক পিতা পিতামহ ধরিয়া এই কথা শুনিয়া আসিয়াছে’- মস্ত্ৰে তোমাদের দরকার নাই, পূজায় তোমাদের প্রয়ােজন নাই, দেবমন্দিরে তোমাদের প্রবেশ নাই; তোমাদের কাছে ধর্মের দাবি, তোমাদের ক্ষুদ্র সাধের পরিমাণে, যৎকিঞ্চিৎ মাত্র। তােমরা স্কুলকে লইয়াই থাকে, চিত্তকে অধিক উচ্চ তুলিতে হইবে না, যেখানে আছ, ঐখানেই নীচে পড়িয়া থাকিয়া সহজে তোমরা ধর্মের ফললাভ করিতে পারবে । , অথচ হীনতম মানুষেরও একটিমাত্র সম্মানের স্থান আছে ধর্মের দিকে- তাহার জানা উচিত সেইখনেই তাহার অধিকারের কোনো সংকোচ নাই। রাজা বল, পণ্ডিত বল, অভিজাত বল, সংসারের ক্ষেত্রেই তাহাদের যত কিছু প্ৰতাপ প্ৰভুত্ব- ধর্মের ক্ষেত্রে দীনহীন মূর্থেরও অধিকার কোনো কৃত্রিম শাসনের দ্বারা সংকীর্ণ করিবার ভার কোনো মানুষের উপর নাই। ধর্মই মানুষের সকলের চেয়ে বড়ো আশী- সেইখানেই তাহার মুক্তি, কেননা সেইখনেই তাহার সমন্ত ভবিষ্যৎ, সেইখনেই তাহার অন্তহীন সম্ভাব্যতা, ক্ষুদ্র বর্তমানের সমস্ত সংকোচ সেইখনেই ঘুচিতে পারে। অতএব সংসারের দিকে, জন্ম বা যোগ্যতার প্রতি । চাহিয়া মানুষের স্বত্বকে যতই খণ্ডিত কর না, ধর্মের দিকে কোনো মানুষের জন্য কোনো বাধা সৃষ্টি করিতে পারে এতবড়ো স্পর্ধিত অধিকার কোনো পরমজ্ঞানী পুরুষের কোনো চক্রবর্তী সম্রাটের নাই। ধর্মের অধিকার বিচার করিয়া তাহার সীমা নির্দেশ করিয়া দিতে পার-তুমি কে যে তোমার সেই অলৌকিক শক্তি আছে। তুমি কি অন্তর্যামী ? মানুষের মুক্তির ভার তুমি গ্রহণ করিবার অহংকার রাখা ? তুমি লোকসমাজ, তুমি লৌকিক ব্যবহারেও আপনাকে সামলাইতে পার না, কত তোমার পরাভব, কত তোমার বিকৃতি, কত তোমার প্রলোভন- তুমিই তোমার অত্যাচারের লাঠিটাকে ধর্মের নামে গিল্ট করিয়া