পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Öዓbr রবীন্দ্র-রচনাবলী সমাজে যখন একটা বড়ো ভাব সংক্রামকরূপে দেখা দেয় তখন তাহা একান্তভাবে কোনো গণ্ডিকে মনে না। আর্যজাতির নিজেদের মধ্যে একটা ঐক্যবােধ যতই পরিস্ফুট হইয়া উঠিল ততই সমাজের সর্বত্রই এই অনুভূতি সঞ্চারিত হইতে লাগিল যে, দেবতারা নামে নানা কিন্তু সত্যে এক ; অতএব বিশেষ দেবতাকে বিশেষ স্তব ও বিশেষ বিধিতে সন্তুষ্ট করিয়া বিশেষ ফল পাওয়া যায় এই ধারণা সমাজের সর্বত্রই ক্ষয় হইয়া দলভেদে উপাসনাভেদ স্বভাবতই ঘূচিবার চেষ্টা করিল। তথাপি ইহা সত্য যে, বিশেষভাবে ক্ষত্রিয়ের মধ্যেই ব্ৰহ্মবিদ্যা অনুকূল আশ্রয় লাভ করিয়ছিল এবং সেইজন্যই ব্ৰহ্মবিদ্যা রাজবিদ্যা নাম গ্ৰহণ করিয়াছে। ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে এই প্ৰভেদটি সামান্য নহে। ইহা একেবারে বাহিরের দিক ও অন্তরের দিকের ভেদ। বাহিরের দিকে যখন আমরা দৃষ্টি রাখি। তখনই আমরা কেবলই বহুকে ও বিচিত্ৰকে দেখিতে পাই, অন্তরে যখন দেখি তখনই একের দেখা পাওয়া যায়। যখন আমরা বাহ্যশক্তিকেই দেবতা বলিয়া জানিয়াছি তখন মন্ত্রতন্ত্র ও নানা বাহ্য প্রক্রিয়ার দ্বারা তাহাদিগকে বাহির হইতে বিশেষভাবে আপনাদের পক্ষভুক্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। এইজন্য বাহিরের বহু শক্তিই যখন দেবতা তখন বাহিরের নানা অনুষ্ঠানই আমাদের ধর্মকাৰ্য এবং এই অনুষ্ঠানের প্রভেদ ও তাঁহারই গুঢ়াশক্তি-অনুসারেই ফলের তারতম্য কল্পনা। এইরূপে সমাজে যে আদর্শের ভেদ হইয়া গেল, সেই আদর্শভেদের মূর্তিপরিগ্রহশ্বরূপে আমরা দুই দেবতাকে দেখিতে পাই। প্রাচীন বৈদিক মন্ত্রতন্ত্র ক্রিয়াকাণ্ডের দেবতা ব্ৰহ্মা এবং নব্যদলের দেবতা বিষ্ণু । ব্ৰহ্মার চারি মুখ চারি বেদ-তােহা চিরকালের মতো ধ্যানরত স্থির; আরবিষ্ণুর চারিক্রিয়াশীল হস্ত কেবলই নব নব ক্ষেত্রে মঙ্গলকে ঘোষিত করিতেছে, ঐক্যচক্রকে প্রতিষ্ঠিত করিতেছে, শাসনকে প্রচারিত করিতেছে এবং সৌন্দর্যকে বিকাশিত করিয়া তুলিতেছে। . . দেবতারা যখন বাহিরে থাকেন, যখন মানুষের আত্মার সঙ্গে তঁহাদের আত্মীয়তার সম্বন্ধ অনুভূত না হয় তখন তাহদের সঙ্গে আমাদের কেবল কামনার সম্বন্ধ ও ভয়ের সম্বন্ধ। তখন তঁহাদিগকে স্তবে বশ করিয়া আমরা হিরণ্য চাই, গো চাই, আয়ু চাই, শত্রুপরাভব চাই; যাগযজ্ঞ-অনুষ্ঠানের ত্রুটি অসম্পূর্ণতায় তাহারা অপ্ৰসন্ন হইলে আমাদের অনিষ্ট করবেন। এই আশঙ্কা তখন আমাদিগকে অভিভূত করিয়া রাখে। এই কামনা এবং ভয়ের পূজা বাহা পূজা, ইহা পরের পূজা। দেবতা যখন অন্তরের ধন হইয়া উঠেন তখনই অন্তরের পূজা আরম্ভ হয়- সেই পূজাই ভক্তির পূজা। ভারতবর্ষের ব্রহ্মবিদ্যার মধ্যে আমরা দুইটি ধারা দেখিতে পাই, নিৰ্গুণ ব্ৰহ্ম ও সগুণ ব্ৰহ্ম, অভেদ ও ভেদাভেদ। এই ব্রহ্মবিদ্যা কখনো একের দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকিয়ছে, কখনো দুইকে মানিয়া সেই দুইয়ের মধ্যেই এককে দেখিয়ছে। দুইকে না মানিলে পূজা হয় না, আবার দুইয়ের মধ্যে এককে না মানিলে ভক্তি হয় না। দ্বৈতবাদী য়িহুদিদের দূরবতী দেবতা ভয়ের দেবতা, শাসনের দেবতা, নিয়মের দেবতা। সেই দেবতা নূতন টেস্টামেন্টে যখন মানবের সঙ্গে এক হইয়া মিশিয়া আমীয়তা স্বীকার করিলেন তখনই তিনি প্রেমের দেবতা ভক্তির দেবতা হইলেন। বৈদিক দেবতা যখন মানুষ হইতে পৃথক তখন তাহার পূজা চলিতে পারে। কিন্তু পরমাত্মা ও জীবাত্মা যখন আনন্দের অচিন্ত্যুরহস্যলীলায় এক হইয়াও দুই, দুই হইয়াও এক, তখনই সেই অন্তরতম দেবতাকে ভক্তি করা চলে। এইজন্য ব্ৰহ্মবিদ্যার আনুষঙ্গিকরপেই ভারতবর্ষে প্ৰেমভক্তির ধর্ম আরম্ভ হয়। এই ভক্তিধর্মের দেবতাই বিষ্ণু । বিপ্লবের অবসানে বৈষ্ণবধর্মকে ব্ৰাহ্মণেরা আপন করিয়া লইয়াছেন। কিন্তু গোড়ায় যে তাহা করেন নাই তাহার কিছু কিছু প্রমাণ এখনাে অবশিষ্ট আছে। বিকুর বক্ষে ব্ৰাহ্মণ ভূণ্ড পদাঘাত করিয়াছিলেন এই কাহিনীর মধ্যে একটি বিরোধের ইতিহাস সংহত হইয়া আছে। এই ভৃগু যজ্ঞকৰ্তা ও যজ্ঞফলভাগীদের আদর্শরূপে বেদে কথিত আছেন। ভারতবর্ষে পূজার আসনে ব্ৰহ্মার স্থানকে সংকীর্ণ করিয়া বিকুইযখন তাহা অধিকার করিলেন- বহুপল্পবিত যাগযজ্ঞ ক্রিয়াকাণ্ডের যুগকে পশ্চাতে ফেলিয়া ভক্তিধর্মের যুগ যখন ভারতবর্ষে আবির্ভূত হইল তখন সেই সন্ধিক্ষণে একটা বড়ো ঝড় আসিয়াছিল। আসিবারই কথা। এই পাইয়াছিলেন, তাহারা সহজে তাহার বেড়া ভাঙিতে দেন নাই। : এই ভক্তির বৈষ্ণবধর্ম যে বিশেষভাবে ক্ষত্ৰিয়ের প্রবর্তিত ধৰ্ম, তাহার একটি প্রমাণ একদা ক্ষত্ৰিয়