পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিচয় 6:byዓ দিক আছে কারণ এই দুইটি দিক ব্যতীত কোনাে একটি দিকও সত্য হইতে পারে না। লজিক ইহার কোনাে সমন্বয় পায় না, এইজন্য যেখানে ইহার সমন্বয় সেখানে ইহাকে অনির্বাচনীয় বলা হয়। ব্যাসের ব্ৰহ্মসূত্রে এই দ্বৈত অদ্বৈত দুই দিককেই রক্ষা করা হইয়াছে। এইজন্য পরবর্তীকালে এই একই ব্ৰহ্মসূত্রকে লজিক নানা বাদ-বিবাদে বিভক্ত করিতে পারিয়াছে। ফলত ব্ৰহ্মসূত্রে আর্যধর্মের মূলতত্ত্বটি দ্বারা সমস্ত আর্যধর্মশাস্ত্ৰকে । এক আলোকে আলোকিত করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে। কেবল আর্যধর্মকেন সমস্ত মানবের ধর্মের ইহাই এক আলোক । 河 এইরূপে নানা বিরুদ্ধতার দ্বারা পীড়িত আৰ্যপ্রকৃতি একদিন আপনার সীমা নির্ণয় করিয়া আপনার মূল ঐক্যটি লাভ করিবার জন্য একান্ত যত্নে প্রবৃত্ত হইয়াছিল তাহার লক্ষণ স্পষ্টই দেখিতে পাওয়া যায়। তাই, আর্য জাতির বিধিনিষেধগুলি যাহা কেবল স্মৃতিরূপে নানাস্থানে ছড়াইয়া ছিল এই সময়ে তাহাও সংগৃহীত হইয়া লিপিবদ্ধ হইতে লাগিল । আমরা এই যে মহাভারতের কথা এখানে আলোচনা করিলাম ইহাকে কেহ যেন কালগত যুগ না মনে করেন- ইহা ভাবগত যুগ-অর্থাৎ আমরা কোনো একটি সংকীর্ণকালে ইহাকে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করিতে পারি না। বৌদ্ধযুগের যথার্থ আরম্ভ কবে তাহা সুস্পষ্টরূপে বলা অসম্ভব- শাক্যসিংহের বহু পূর্বেই যে তাহার আয়োজন চলিতেছিল এবং তঁহার পূর্বেও যে অন্য বুদ্ধ ছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই। ইহা একটি ভাবের ধারাপরস্পরা যাহা গীেতমবুদ্ধে পূর্ণ পরিণতি লাভ করিয়াছিল। মহাভারতের যুগও তেমনি কবে আরম্ভ তাহা স্থির করিয়া বলিলে ভুল বলা হইবে। পূর্বেই বলিয়াছি সমাজের মধ্যে ছড়ানো ও কুড়ানো একসঙ্গেই চলিতেছে। যেমন পূর্ব মীমাংসা ও উত্তর-মীমাংসা। ইহা যে পুরাতন পক্ষ ও নূতন পক্ষের বোঝাপড়া তাহাতে সন্দেহ নাই। এক পক্ষ বলিতেছেন যে সকল মন্ত্র ও কর্মকাণ্ড চলিয়া আসিয়াছে তাহা অনাদি, তাহার বিশেষ গুণবশতই তাহার দ্বারাই চরমসিদ্ধি লাভ করা যায়। অপর পক্ষ বলিতেছেন জ্ঞান ব্যতীত আর কোনো উপায়ে মুক্তি নাই।.. যে দুই গ্ৰন্থ আশ্রয় করিয়া এই দুই মত বর্তমানে প্রচলিত আছে তাহার রচনাকাল যখনই হউক এই মতদ্বৈধ যে অতি পুরাতন তাহা নিঃসন্দেহ। এইরূপ আৰ্যসমাজের যে উদ্যম আপনার সামগ্ৰীগুলিকে বিশেষভাবে সংগৃহীত ও শ্রেণীবদ্ধ করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছে এবং যাহা সুদীর্ঘকাল ধরিয়া ভিন্ন ভিন্ন পুরাণ সংকলন করিয়া স্বজাতির প্রাচীন পথটিকে চিহ্নিত করিয়া আসিয়াছে তাহা বিশেষ কোনো সময়ে সীমাবদ্ধ নহে। আৰ্য-অনার্যের চিরন্তন সংমিশ্রণের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষের এই দুই বিরুদ্ধ শক্তি চিরকালই কাজ করিয়া আসিয়াছে; ইহাই আমাদের বক্তব্য । এ কথা কেহ যেন না মনে করেন যে অনার্যেরা আমাদিগকে দিবার মতো কোনো জিনিস দেয় নাই। বস্তুত প্রাচীন দ্রাবিড়গণ সভ্যতায় হীন ছিল না। তাহদের সহযোগে হিন্দুসভ্যতা, রূপে বিচিত্র ও রসে গভীর হইয়াছে। দ্রাবিড় তত্ত্বজ্ঞানী ছিল না। কিন্তু কল্পনা করিতে, গান করিতে এবং গাড়িতে পারিত । কলাবিদ্যায় তাহারা নিপুণ ছিল এবং তাঁহাদের গণেশ দেবতার বধু ছিল কলাবধূ। আর্যদের বিশুদ্ধ তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে দ্রাবিড়ের রসপ্রবণতা ও রূপোদ্ভাবনী শক্তির সংমিশ্ৰণ-চেষ্টায় একটি বিচিত্র সামগ্ৰী গড়িয়া উঠিয়াছে। তাহা সম্পূর্ণ আৰ্যও নহে, সম্পূর্ণ অনাৰ্যও নহে, তাঁহাই হিন্দু। এই দুই বিরুদ্ধের নিরন্তর সমন্বয়প্রয়াসে ভারতবর্ষ একটি আশ্চর্য সামগ্ৰী পাইয়াছে। তাহা অনন্তকে অন্তের মধ্যে উপলব্ধি করিতে শিখিয়ছে এবং ভূমীকে প্রাত্যহিক জীবনের সমস্ত তুচ্ছতার মধ্যেও প্রত্যক্ষ করিবার অধিকার লাভ করিয়াছে। এই কারণেই ভারতবর্ষে এই দুই বিরুদ্ধ যেখানে না মেলে সেখানে মুঢ়তা ও অন্ধ সংস্কারের আর অন্ত থাকে না ; যেখানে মেলে সেখানে অনন্তের অন্তহীন রসরাপ আপনাকে অবাধে সর্বত্র উদঘাটিত করিয়া দেয়। এই কারণেই ভারতবর্ষ এমন একটি জিনিস পাইয়াছে যাহাকে ঠিকমত ব্যবহার করা সকলের সাধ্যায়ত্ত নহে, এবং ঠিকমত ব্যবহার করিতে না পরিলে যাহা জাতির জীবনকে মুঢ়তার ভারে বুলিলুষ্ঠিত করিয়া দেয়। আর্য ও দ্রাবিড়ের এই চিত্তবৃত্তির বিরুদ্ধতার সম্মিলন যেখানে সিদ্ধ হইয়াছে সেখানে সৌন্দৰ্য জাগিয়াছে, যেখানে হওয়া সম্ভবপর হয় নাই। সেখানে কদৰ্যতার সীমা দেখি না। এ কথাও মনে রাখিতে হইবে শুধু দ্রাবিড় নহে, বর্বর অনার্যদের সামগ্ৰীও একদিন স্থার খোলা পাইয়া অসংকোচ আৰ্যসমাজে প্ৰবেশলাভ করিয়াছে। এই অনধিকার-প্রবেশের বেদনাবােধ বহুকাল ধরিয়া আমাদের সমাজে সুতীব্র হইয়া ছিল।