পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিচয় । @እd লাইয়া অনেকে আক্ষেপ প্রকাশ করিতেছেন যে, বিদেশী চিকিৎসা আমাদের পক্ষে অস্বাভাবিক এবং ইহাতে আমাদের শরীর জীর্ণ হইয়া গেল, দেশ উজাড় হইবার জো হইল। কিন্তু তবুকুইনিনমিকস্টার যে অহিন্দু এমন কথা কোনাে তত্ত্বব্যাখ্যার দ্বারা আজও প্রমাণের চেষ্টা হয় নাই। ডাক্তারের ভিজিটে এবং ঔষধের উগ্র উপদ্রবে। যদি আমি ধনপ্রাণে মারি তবু আমি হিন্দু এ কথা অস্বীকার করা চলিবে না। অথচ হিন্দু আয়ুর্বোেদর প্রথম অধ্যায় হইতে শেষ পর্যন্ত খুঁজতে ঔষধতালিকার মধ্যে কুইনিনের নাম পাওয়া যাইবে না। এই যেমন শরীরের কথা বললাম, তেমনি শরীরের চেয়ে বড়ো জিনিসেরও কথা বলা যায়। কারণ, শরীর রক্ষাই তাে মানুষের একমাত্র নহে, তাহার যে প্রকৃতি ধর্মকে আশ্ৰয় করিয়া সুস্থ ও বলিষ্ঠ থাকে তাহাকেও বঁাচাইয়া চলিতেই হইবে। সমাজের অধিকাংশ লোকের এমন মত হইতে পারে যে, তাহাকে ধাচাইয়া চলিবার উপযোগী ধর্ম আয়ুৰ্বেদ আমাদের দেশে এমনই সম্পূর্ণ হইয়া গিয়াছে যে, সে সম্বন্ধে কাহারও কোনাে কথা চলিতে পারে না। এটা তাে একটা বিশ্বাসমাত্র, এরূপ বিশ্বাস সত্যও হইতে পারে। মিথ্যাও হইতে পারে, অতএব যে লোকের প্রাণ লইয়া কথা সে যদি নিজের বিশ্বাস লইয়া অন্য কোনো একটা পন্থা অবলম্বন করে তবে গায়ের জোরে তাহাকে নিরস্ত করিতে পারি। কিন্তু সত্যের জোরে পারি না । গায়ের জোরের তো যুক্তি নাই। পুলিস দারোগ যদি ঘুষ লইয়া বলপূর্বক অন্যায় করে তবে দুর্বল বলিয়া আমি সেটাকে হয়তো মানিতে বাধ্য হইতে পারি। কিন্তু সেইটােকেই রাজ্যশাসনতন্ত্রের চরম সত্য বলিয়া কেন স্বীকার করিব ? তেমনি হিন্দুসমােজ যদি ধােবানাপিত বন্ধ করিবার ভয় দেখাইয়া আমাকে বলে অমুক বিশেষ ধর্মটাকেই তোমার মানিতে হইবে কারণ এইটেই হিন্দুধর্ম- তবে যদি ভয় পাই তবে ব্যবহারে মানিয়া যাইব কিন্তু সেইটেই যে হিন্দুসমাজের চরম সত্য ইহা কোনোক্রমেই বলা চলিবে না। যাহা কোনো সভ্য সমাজেরই চরম সত্য নহোতাহা হিন্দুসমাজেরও নহে, ইহা কোটি কোটি বিরুদ্ধবাদীর মুখের উপরেই বলা যায়- কারণ, ইহাই সত্য । হিন্দুসমাজের ইতিহাসেও ধর্মবিশ্বাসের অচলতা আমরা দেখি নাই। এখানে পরে পরে যত ধৰ্মবিপ্লব ঘটয়াছে এমন আর কোথাও ঘটে নাই। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যে সকল দেবতা ও পূজা আৰ্যসমাজের । নহে তাহাও হিন্দুসমাজে চলিয়া গিয়াছে- সংখ্যা হিসাবে তাহারাই সব চেয়ে প্রবল। ভারতবর্ষে উপাসকসম্প্রদায়সম্বন্ধে যে-কোনো বই পড়লেই আমরা দেখিতে পাইব হিন্দুসমাজে ধর্মাচরণের কেবল যে বৈচিত্ৰ্য আছে তাহা নহে, তাহারা পাশাপাশি আছে, ইহা ছাড়া তাঁহাদের পরস্পরের আর কোনাে ঐক্যসূত্র খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। যদি কাহাকেও জিজ্ঞাসা করি, কোন ধর্ম হিন্দুর ধর্ম, যেটা না মানিলে তুমি আমাকে হিন্দু বলিয়া স্বীকার করিবে না ? তখন এই উত্তর পাওয়া যায়, যে-কোনাে ধৰ্মই কিছুকাল ধরিয়া যে-কোনো সম্প্রদায়ে হিন্দুধর্মবলিয়া গণ্য হইয়াছে। ধর্মের এমনতরো জড়সংজ্ঞা আর হইতেই পারে না। যাহা শ্রেয় বা যাহার আন্তরিক কোনাে সৌন্দর্য বা পবিত্ৰতা আছে তাঁহাই ধর্ম, এমন কোনাে কথা নাই; স্তুপের মধ্যে কিছুকাল যাহা পড়িয়া আছে তাহাই ধর্ম- তাহা যদি বীভৎস হয়, যদি তাহাতে সাধারণ ধর্মনীতির সংযমনষ্ট । হইতে থাকে তথাপি তাহাও ধর্ম। এমন উত্তর যতগুলি লোকে মিলিয়াই দিক-না কেন তথাপি তাহাকে আমি আমার সমাজের পক্ষের সত্য উত্তর বলিয়া কোনোমতেই গ্ৰহণ করিব না । কেননা, লোক গণনা করিয়া ওজন দরে বা গজের মাপে সত্যের মূল্যনিৰ্ণয় হয় না। নানাপ্রকার অনার্য ও বীভৎস ধর্ম কেবলমাত্র কালক্রমে আমাদের সমাজে যদি স্থান পাইয়া থাকে। তবে যে-ধর্মকে আমার জ্ঞান বুদ্ধি ও ভক্তির সাধনায় আমি শ্রেষ্ঠ বলিয়া গ্ৰহণ করিয়াছি, সেই ধর্মদীক্ষার দ্বারা আমি হিন্দুসমাজের মধ্যে আমার সত্য অধিকার হইতে বঞ্চিত হইব এতবড়ো অন্যায় আমরা কখনোই মানিতে পারিব না। ইহা অন্যায়, সুতরাং ইহা হিন্দুসমাজের অথবা কোনো সমাজেরই নহে। প্রশ্ন এই, হিন্দুসমাজ যদি জড়ভাবে ভালোমন্দ সকলপ্রকার ধর্মকেই পিণ্ডাকার করিয়া রাখে এবং যদি কোনো নূতন উচ্চ আদর্শক প্রবেশে বাধা দেয়। তবে এই সমাজকে তোমার সমাজ বলিয়া স্বীকার করিবার দরকার কী ? ইহার একটা উত্তর পূর্বেই দিয়াঁহি-তাহা এই যে, ঐতিহাসিক দিক দিয়া আমি যে হিন্দু এ সম্বন্ধে আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো তর্কই নাই। : এ সম্বন্ধে আরো একটা বলিবার আছে। তোমার পিতা যেখানে অন্যায় করেন সেখানে তাহার প্রতিকার