পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ŵ900 রবীন্দ্র-রচনাবলী ব্ৰহ্মাণ্ডকে আমি কােনাে অণ্ডবিশেষ বলিয়া মনে করি না ইহা জানিতে পারলে এবং সুযোগ পাইল প্রপিতামহ এই প্রকার অদ্ভুত নব্যতায় নিঃসন্দেহ আমার কান মলিয়া দিতেন। . কিন্তু চীনের মুসলমানও মুসলমান, পারস্যেরাও তাই আফ্রিকারীও তদুপ। যদিচ চীনের মুসলমানসম্বর আমি কিছুই জানি না তথাপি এ কথা জোর করিয়াই বুলিতে পারি যে, বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে অহা ধর্মমতের অনেকটা হয়তো মেলে কিন্তু অন্য অসংখ্য বিষয়েই মেলে না। এমনকি, ধর্মমতেরও মোট বিষয়ে মেলে। কিন্তু সূক্ষ্ম বিষয়ে মেলে না। অথচ হাজার হাজার বিষয়ে তাহার স্বজাতি কনফুসীয় অঙ্গ বীেদ্ধের সঙ্গে তাহার মিল আছে। পারস্যে চীনের মতো কোনো প্রাচীনতর ধর্মমত নাই বললেই হয়। মুসলমান বিজেতার প্রভাব সমস্ত দেশে এক মুসলমানধর্মই স্থাপিত হইয়াছে,তথাপি পারস্যে মুসলমান সেখানকার পুরাতন জুতিগত প্রকৃতির মধ্যে পড়িয়া নানা বৈচিত্র লাভ করিতেছে- আজ পর্যন্ত । ভারতবর্ষেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হইতে পারেন। এখানেও আমার জাতিপ্রকৃতি আমার মতবিশেষের চেয়ে অনেক ব্যাপক। হিন্দুসমাজের মধ্যেই তাহার হাজার দৃষ্টান্ত আছে। যেসকল আচার আমাদেশ এবং প্রথায় অহিন্দুবলিয়া গণ্য ছিল আজকত হিন্দু তাহা প্রকাশ্যেইলঙ্ঘনকািরয়া চলিয়াছে; কত লোক আমরা জানি ধ্যাহারা সভায় বস্তৃতা দিবার ও কাগজে প্ৰবন্ধ লিখিবর বেলায় আচারের স্বলন লেশমাত্ৰাসয় করিতে পারেন না। অথচ ধাঁহাদের পানাহারের তালিকা দেখিলে মনু ও পরাশর নিশ্চয়ই উদবিগ্ন হয়। উঠিবেন এবং রঘুনন্দন আনন্দিত হইবেন না। তঁহাদের প্রবন্ধের মত অথবা ঠাঁহাদের ব্যাবহারিক মন্ত হিন্দুসমাজে আজ র্যাহারা আচার মানেন না, নিমন্ত্রাণরক্ষায় র্যাহারা ভাটপাড়ার বিধান রক্ষা করেন না, এবং গুরু বাড়ি আসিলে গুরুতর কাজের ভিড়ে র্যাহাঁদের অনবসর ঘটে, তাহারও স্বচ্ছন্দে হিন্দু বলিয়া গণ্য হইতেছেন। তাহার একমাত্র কারণ এ নয় যে হিন্দুসমাজ দুর্বল- তাহার প্রধান কারণ এই যে, সমস্ত বীধাৰ্বাধির মধ্যেও হিন্দুসমাজ একপ্রকার অর্ধচতন ভাবে অনুভব করিতে পারে যে, বাহিরের এই সমস্ত পরিবর্তন হাজার হইলেও তবু বাহিরের- যথার্থ হিন্দুত্বের সীমা এইটুকুর মধ্যে কখনোই বদ্ধ যে কথাটা সংকীর্ণবর্তমানের উপস্থিত অবস্থাকে অতিক্রমকরিয়া বৃহৎভাবে সত্য, অনেক পাকা লোকেরা তাহার উপরে কোনো আস্থাই রাখেন না। তাহারা মনে করেন এ-সমস্ত নিছক আইডিয়া । মনে করেন করুন কিন্তু আমাদের সমাজে আজ এই আইডিয়ার প্রয়োজনই সকলের চেয়ে বড়ো প্রয়োজন। এখানে জড়ত্বের আয়োজন যথেষ্ট আছে যাহা পড়িয়া থাকে, বিচার করে না, যাহা অভ্যাসমােত্র, যাহা নড়িতে চায় না। তাহা এখানে যথেষ্ট আছে, এখানে কেবল সেই তত্ত্বেরই অভাব দেখিতেছি, যাহা সৃষ্টিকরে, পরিবর্তন করে, অগ্রসর করে, যাহা বিচিত্রকে অন্তরের দিক হইতে মিলাইয়া এক করিয়া দেয়। হিন্দুসমাজ ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে সেই আইডিয়াকেই জন্ম দিয়াছে, যাহা তাহাকে উদবোধিত করবে, যাহা তাহাকে চিন্তা করাইবে, চেষ্টা করাইবে, সন্ধান করাইবে ; যাহা তাহার নিজের ভিতরকার সমস্ত অনৈক্যাকে সত্যের বন্ধনে এক করিয়া বঁধিয়া তুলিবার সাধনা করিবে, যাহা জগতের সমস্ত প্রাণশক্তির সঙ্গে তাহার প্রাণক্রিয়ার যোগসাধন করিয়া দিবে। এই যে আইডিয়া, এই যে সৃজনশক্তি, চিত্তশক্তি, সত্যগ্রহণের সাধনা, এই যে প্রাণচেষ্টার প্রবল বিকাশ, যাহা ব্ৰাহ্মসমাজের মধ্যে আকার গ্রহণ করিয়া উঠিয়াছে তাহাকে আমরা হিন্দুসমাজের বলিয়া অস্বীকার করিব ? যেন আমরাই তাহার মালোক, আমরাই তাহার জন্মদাতা। হিন্দুসমাজের এই নিজেরই ইতিহাসগত প্ৰাণগত সৃষ্টি হইতে আমরা হিন্দুসমাজকেই বঞ্চিত করিতে চাহিব ? আমরা হঠাৎ এত বড়ো অন্যায় কথা বলিয়া বসিব যে, যাহা নিশ্চল, যােহা বাধা, যাহা প্রাণহীন তাহাই হিন্দুসমাজের, আর যাহা তাহার আইডিয়া, তাহার মানসরূপ, তাহার মুক্তির সাধনা, তাহাই হিন্দুসমাজের নহে, তাহাই বিশ্বের সরকারি জিনিস। এমন করিয়া হিন্দুসমাজের সত্যকে বিচ্ছিন্ন করিবার চেষ্টাই কি ব্ৰাহ্মসমাজের চেষ্টা ? ? এতদূর পর্যন্ত আসিয়াও আমার শ্রোতা বা পাঠক যদি একজনও বাকি থাকেন,তবে তিনি নিশ্চয় আমাকে শেষ এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন- যদি জাতিভেদ না মানিয়াও হিন্দুত্ব থাকে, যদি মুসলমান খ্রীস্টান হইয়াও