পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিচয় Vod হিন্দুসমাজের পূর্ণ বিকাশের মূর্তি আমাদের কাছে গ্রত্যক্ষ ব্যাপার নহে। সুতরাং হিন্দুকী করিয়াছে ও কী করিতে পারে সে সম্বন্ধে আমাদের ধারণা দুর্বল ও অস্পষ্ট। এখন আমরা যেটাকে চােখে দেখিতেছি। সেইটেই । আমাদের কাছে প্রবল। তাহা যে নানরূপে হিন্দুর যথার্থ প্রকৃতি ও শক্তিকে আচ্ছন্ন করিয়া তাহাকে বিনাশ করিতেছে। এ কথা মনে করা আমাদের পক্ষে কঠিন। পাঁজিতে যে সংক্রাত্তির ছবি দেখা যায় আমাদের কাছে হিন্দুসভ্যতার মূর্তিটা সেইরকম। সে কেবলুইযেন স্নান করিতেছে, জপ করিতেছে, এবং ব্ৰত উপবাসে কৃশ হইয়া জগতের সমস্ত কিছুর সংস্পর্শ পরিহার করিয়া অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে এক পাশে দাঁড়াইয়া আছে। কিন্তু একদিন এই হিন্দু সভ্যতা সজীব ছিল, তখন সে সমূদ্র পার হইয়াছে, উপনিবেশ বঁধিয়াছে, দিগবিজয় করিয়াছে দিয়াছে এবং নিয়ছে ; তখন তাহার শিল্প ছিল, বাণিজ্য ছিল, তাহার কর্মপ্রবাহ ব্যাপক ও বেগবান ছিল; তখন তাহার ইতিহাসে নব নব মতের অভ্যুত্থান, সমাজবিপ্লব ও ধর্মবিপ্লবের স্থান ছিল; তখন তাহার স্ত্রীসমাজেও বীরত্ব, বিদ্যা ও তপস্যা ছিল; তখন তাহার আচার-ব্যবহার যে চিরকালের মতো লোহার ছাচে ঢালাই করা ছিল না মহাভারত পড়লে পাতায় পাতায় তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। সেই বৃহৎ বিচিত্র, জীবনের-বেগে চঞ্চল, জাগ্ৰত চিত্তবৃত্তির তাড়নায় নব নব অধ্যবসায়ে প্রবৃত্ত হিন্দু সমাজ- যে সমাজ ভুলের ভিতর দিয়া সত্যে চলিয়ছিল ; পরীক্ষার ভিতর দিয়া সিদ্ধান্তে ও সাধনার ভিতর দিয়া সিদ্ধিতে উত্তীর্ণ হইতেছিল ; যাহা শ্লোকসংহিতার জটিল রজ্জ্বতে বাধা কলের পুত্তলীর মতো একই নিজীবী নাট্য প্রতিদিন পুনরাবৃত্তি করিয়া চলিতেছিল না; বীেন্ধ যে সমাজের অঙ্গ, জৈন যে সমাজের অংশ ; মুসলমান ও খ্রীস্টানেরা যে সমাজের অন্তর্গত হইতে পারিত; যে সমাজের এক মহাপুরুষ একদা অনাৰ্যদিগকে মিত্ররূপে গ্ৰহণ করিয়াছিলেন, আর-এক মহাপুরুষ কর্মের আদর্শকে বৈদিক যাগযজ্ঞের সংকীর্ণত হইতে উদ্ধার করিয়া উদার মনুষ্যত্বের ক্ষেত্রে মুক্তিদান করিয়া ছিলেন এবং ধর্মকে বাহ্য অনুষ্ঠানের বিধিনিষেধের মধ্যে আবদ্ধ না করিয়া তাহাকে ভক্তি ও জ্ঞানের প্রশস্ত পথে সর্বলোকের সুগম করিয়া দিয়াছিলেন ; সেই সমাজকে আজ আমরা হিন্দুসমাজ বলিয়া স্বীকার করিতেই চাই না-যাহা চলিতেছে না। তাঁহাকে আমরা হিন্দুসমাজ বলি ; প্রাণের ধর্মকে আমরা হিন্দুসমাজের ধর্মবলিয়া মানিইনা, কারণ, প্ৰাণের ধর্মবিকাশের ধর্ম পরিবর্তনের ধর্ম তাহা নিয়ত গ্ৰহণ-বর্জনের ধর্ম। এইজন্যই মনে আশঙ্কা হয় যাহারা হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতে উদযোগী, তাহারা কিরূপ হিন্দুত্বের ধারণা লইয়া এই কার্যে প্রবৃত্ত ? কিন্তু সেই আশঙ্কামাত্রেই নিরন্ত হওয়াকে আমি শ্ৰেয়স্কর মনে করি না। কারণ, হিন্দুত্বের ধারণাকে তো আমরা নষ্ট করিতে চাই না, হিন্দুত্বের ধারণাকে আমরা বড়ো করিয়া তুলিতে চাই। তাহাকে চালনা করিতে দিলে আপনি সে বড়ো হইবার দিকে যাইবেই- তাহাকে গর্তের মধ্যে বঁধিয়া রাখিলেই তাহার ক্ষুদ্রতা ও বিকৃতি অনিবাৰ্য। বিশ্ববিদ্যালয় সেই চালনার ক্ষেত্ৰ— কারণ সেখানে বুদ্ধিরই ক্রিয়া, সেখানে চিত্তকে সচেতন করারই আয়ােজন। সেই চেতনার স্রোত প্রবাহিত হইতে থাকিলে আপনিই তাহা ধীরে ধীরে জড় সংস্কারের সংকীর্ণতাকে ক্ষয় করিয়া আপনাকে প্রশস্ত করিয়া তুলিবেই। মানুষের মনের উপর আমি পুরা বিশ্বাস রাখি ; ভুল লইয়াও যদি আরম্ভ করিতে হয় সেও ভালো, কিন্তু আরম্ভ করিতেই হইবে, নতুবা ভুল কাটিবে না। ছাড়া পাইলে সে চলিবেই। এইজন্য যে সমাজ অচলতাকেই পরমাৰ্থ বলিয়া জ্ঞান করে সে-সমাজ অচেতনতাকেই আপনার সহায় জানে এবং সর্বাগ্রে মানুষের মন-জিনিসকেই অহিফেন খাওয়াইয়া বিহবল করিয়া রাখে। সে এমন সকল ব্যবস্থা করে যাহাতে মন কোথাও বাহির হইতে পায় না, বাধা-নিয়মে একেবারে বন্ধ হইয়া থাকে, সন্দেহ করিতে ভয় করে, চিন্তা করিতেই ভুলিয়া যায়। কিন্তু কোনো বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য যেমনই হােক মনকে তো সে বধিয়া ফেলিতে পরিবে না, কারণ, মনকে চলিতে দেওয়াই তাহার কাজ। অতএব যদি হিন্দু সত্যই মনে করে শাস্ত্ৰলোকের দ্বারা চিরকালের মতো দৃঢ়বন্ধ জড়নিশ্চলতাই হিন্দুর প্রকৃত বিশেষত্ব- তবে সেই বিশেষত্ব রক্ষা করিতে হইলে বিশ্ববিদ্যালয়কে সর্বতোভাবে দূরে পরিহার করাই তাহার পক্ষে কর্তব্য হইবে। বিচারহীন আচারকে মানুষ করিবার ভার যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর দেওয়া হয় তবে ডাইনের হতে পুত্ৰ সমৰ্পণ করা হইবে । ) কিন্তু যাহারা সত্যই বিশ্বাস করেন, হিন্দুদ্ধের মধ্যে কোনো গতিবিধি নাই- তাহা স্থাবর পদার্থবর্তমানকালের প্রবল আঘাতে পাছে সে লেশমাত্র বিচলিত হয়, পাছে তাহান্ন স্থাবরধর্মের তিলমাত্ৰ বৈলক্ষণ্য