পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিচয় ye ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা হয় তখন তিনি অল্পদিনমাত্র ভারতবর্ষে আসিয়াছেন। আমি ভাবিয়ছিলাম সাধারণত ইংরেজ মিশনারি মহিলারা যেমন হইয়া থাকেন ইনিও সেই শ্রেণীর লোক, কেবল ইহার ধর্মসম্প্রদায় স্বতন্ত্ৰ । সেই ধারণা আমার মনে ছিল বলিয়া আমার কন্যাকে শিক্ষা দিবার ভার লইবার জন্য তঁহাকে অনুরোধ করিয়াছিলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কী শিক্ষা দিতে চাও ? আমি বলিলাম,ইংরেজি, এবং সাধারণত ইংরেজি ভাষা অবলম্বন করিয়া যে শিক্ষা দেওয়া হইয়া থাকে। তিনি বলিলেন, বাহির হইতে কোনো একটা শিক্ষা গিলাইয়া দিয়া লাভ কী? জাতিগত নৈপুণ্য ও ব্যক্তিগত বিশেষ ক্ষমতারূপে মানুষের ভিতরে যে জিনিসটা আছে তাহাকে জাগাইয়া তোলাই আমি যথাৰ্ণশিক্ষা মনে করি। বাধা নিয়মের বিদেশী শিক্ষার দ্বারা সেটাকে চাপা দেওয়া আমার কাছে ভালো বোধ হয় না । মোটের উপর তাহার সেইমতের সঙ্গে আমার মতের অনৈক্য ছিলনা। কিন্তু কেমন করিয়া মানুষের ঠিক স্বকীয় শক্তি ও কৌলিক প্রেরণাকে শিশুর চিত্তে একেবারে অস্কুরেই আবিষ্কার করা যায় এবং তাঁহাকে এমন করিয়া জাগ্রত করা যায় যাহাতে তাহার নিজের গভীর বিশেষত্ব সার্বভৌমিক শিক্ষার সঙ্গে ব্যাপকভাবে সুসংগত হইয়া উঠিতে পারে তাহার উপায় তো জানি না। কোনো অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন গুরু এ কাজ নিজের সহজবোধ হইতে করিতেও পারেন, কিন্তু ইহা তো সাধারণ শিক্ষকের কর্ম নহে। কাজেই আমরা প্রচলিত শিক্ষাপ্রণালী অবলম্বন করিয়া মোটা রকমে কাজ চালাই। তাহাতে অন্ধকারে ঢ়েলা মারা হয়তাহাতে অনেক ঢেলা অপব্যয় হয়, এবং অনেক ঢেলা ভুল জায়গায় লাগিয়া ছাত্ৰ বেচারাকে আহত করে। মানুষের মতো চিত্তবিশিষ্ট পদার্থক লইয়া এমনতরো পাইকারি ভাবে ব্যবহার করিতে গেলে প্ৰভূত লোকসান হইবেই সন্দেহ নাই, কিন্তু সমানে সর্বত্র তাহা প্রতিদিনই হইতেছে। যদিচ আমার মনে সংশয় ছিল, এরাপ শিক্ষা দিবার শক্তি র্তাহার আছে কি না, তবু আমি তঁহাকে বলিলাম, আচ্ছা বেশ, আপনার নিজের প্রণালীমতই কাজ করবেন, আমি কোনোপ্রকার ফরমাশ করিতে চাই না। বোধ করি ক্ষণকালের জন্য র্তাহার মন অনুকূল হইয়াছিল, কিন্তু পরীক্ষণেই বলিলেন, না, আমার এ কাজ নহে। বাগবাজারের একটি বিশেষ গলির কাছে তিনি আত্মনিবেদন করিয়াছিলেন- সেখানে তিনি পাড়ার মেয়েদের মাঝখানে থাকিয়া শিক্ষা দিবেন তাহানহে শিক্ষা জাগাইয়া তুলিবেন । মিশনারির মতো মাথা গণনা করিয়া দলবৃদ্ধি করিবার সুযোগকে, কোনো একটি পরিবারের মধ্যে নিজের প্রভাব বিস্তারের উপলক্ষকে, তিনি অবজ্ঞা করিয়া পরিহার করিলেন । তাহার পরে মাঝে মাঝে নানাদিক দিয়া তাহার পরিচয়-লাভের অবসর আমার ঘটিয়াছিল। তঁহার প্রবল শক্তি আমি অনুভব করিয়ছিলাম। কিন্তু সেইসঙ্গে ইহাও বুবিয়ছিলাম তাহার পথ আমার চলিবার পথ নহে। র্তাহার সর্বতমুখী প্রতিভা ছিল, সেইসঙ্গে তাহার আর-একটি জিনিস ছিল, সেটি তাহার যোদ্ধৃত্ব। র্তাহার বল ছিল এবং সেই বল তিনি অন্যের জীবনের উপর একান্ত বেগে প্রয়োগ করতেন- মনকে পরাভূত করিয়া অধিকার করিয়া লইবার একটা বিপুল উৎসাহ ঠাহার মধ্যে কাজ করিত। যেখানে তঁহাকে মানিয়া চলা অসম্ভব। সেখানে তাহার সঙ্গে মিলিয়া চলা কঠিন ছিল। অন্তত আমি নিজের দিক দিয়া বলিতে পারি। র্তাহার সঙ্গে আমার মিলনের নানা অবকাশ ঘটিলেও এক জায়গায় অন্তরের মধ্যে আমি গভীর বাধা অনুভব করিতাম । সে যে ঠিক মতের অনৈক্যের বাধা তােহা নহে, সে যেন একটা বলবান আক্রমণের বাধা । আজ এই কথা আমি অসংকোচে প্রকাশ করিতেছি তাহার কারণ এই যে, একদিকে তিনি আমার চিত্তকে প্রতিহত করা সত্ত্বেও আর-এক দিকে তাহার কাছ হইতে যেমন উপকার পাইয়াছি। এমন আরাকাহারও কাছ হইতে পাইয়াছি বলিয়া মনে হয় না। তাহার সহিত পরিচয়ের পর হইতে এমন বারংবার ঘটিয়াছে যখন র্তাহার চরিত স্মরণ করিয়া ও ঠাহর প্রতি গভীর ভক্তি অনুভব করিয়া আমি প্রচুর বল পাইয়াছি। নিজেকে এমন করিয়া সম্পূর্ণ নিবেদন করিয়া দিবার আশ্চৰ্যশক্তি আর-কোনো মানুষে প্রত্যক্ষ করি নাই। সে সম্বন্ধেষ্ঠাহীর নিজের মধ্যে যেন কোনোপ্রকার বাধাইছিল না। তঁহার শরীর, তাহার আশৈশব যুরোপীয়