পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী অভ্যাস, তাহার আমীয়-স্বজনের স্নেহমমতা, তাহার স্বদেশীয় সমাজের উপেক্ষা এবং যাহাদের জন্য তিনি প্ৰাণ সমর্পণ করিয়াছেন তাহাদের ঔদাসীন, দুর্বলতা ও ত্যাগাখীকারের অভাব কিছুতেই তঁহাকে ফিরাইয়া দিতে পারে নাই। মানুষের সত্যরাপ, টিহুরূপ যে কী, তাহা যে তাঁহাকে জানিয়াছে সে দেখিয়ছে। মানুষের আন্তরিক সত্তা সর্বপ্রকার স্কুল আবরণকে একেবারে মিথ্যা করিয়া দিয়া কিরূপ অপ্রতিহত তেজে প্রকাশ পাইতে পারে তাহা দেখিতে পাওয়া পরম সৌভাগের কথা। ভগিনী নিবেদিতার মধ্যে মানুষের সেই অপরাহত মাহাত্ম্যকে সম্মুখে প্রত্যক্ষ করিয়া আমরা ধন্য হইয়াছি। পৃথিবীতে সকলের চেয়ে বড়ো জিনিস আমরা যাহা কিছু পাই তাহা বিনামূলেই পাইয়া থাকি, তাহার জন্য দরদপ্তর করিতে হয় না। মূল্য চুকাইতে হয় না বলিয়াই জিনিসটা যে কত বড়ো তাহা আমরা সম্পূর্ণ বুঝিতেই পারি না। ভগিনী নিবেদিতা আমাদিগকে যে জীবন দিয়া গিয়াছেন তাহা অতি মহৎজীবন ; তঁহার দিক হইতে তিনি কিছুমাত্র ফাঁকি দেন নাই- প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তেই আপনার যাহা সকলের শ্ৰেষ্ঠ, আপনার যাহা মহত্তম, তাহাঁই তিনি দান করিয়াছেন, সেজন্য মানুষ যতপ্রকার কৃচ্ছসাধন করিতে পারে সমস্তই তিনি স্বীকার করিয়াছেন । এই কেবল তাহার পণ ছিল যাহা একেবারে খাটি তাহাঁই তিনি দিবেন- নিজেকে তাহার সঙ্গে একটুও মিশাইবেন না- নিজের ক্ষুধাতৃষ্ণা, লাভলোকসান, খ্যাতিপ্রতিপত্তি কিছু না- ভয় না, সংকোচ না, আরাম না, বিশ্রাম না। এই যে এতবড়ো আত্মবিসর্জন আমরা ঘরে বসিয়া পাইয়াছি ইহাকে আমরা যে অংশে লঘু করিয়া দেখিব সেই অংশেই বঞ্চিত হইব, পাইয়াও আমাদের পাওয়া ঘটিবে না। এই আত্মবিসর্জনকে অত্যন্ত অসংকোচে নিতান্তই আমাদের প্রাপ্য বলিয়া অচেতনভাবে গ্রহণ করিলে চলিবে না। ইহর পশ্চাতে কত বড়ো একটা শক্তি, ইহার সঙ্গে কী বুদ্ধি, কী হৃদয়, কী ত্যাগ, প্রতিভার কী জ্যোতির্ময় অন্তর্দৃষ্টি আছে তাহা আমাদিগকে উপলব্ধি করিতে হইবে । যদি তাঁহা উপলব্ধি করি তবে আমাদের গর্বদূর হইয়া যাইবে। কিন্তু এখনো আমরা গর্ব করিতেছি। তিনি যে আপনার জীবনকে এমন করিয়া দান করিয়াছেন সে দিক দিয়া তাহার মাহাত্ম্যকে আমরা যে পরিমাণে মনের মধ্যে গ্ৰহণ করিতেছি না, সে পরিমাণে এই ত্যাগাস্বীকারকে আমাদের গর্ব করিবার উপকরণ করিয়া লইয়াছি। আমরা বলিতেছি তিনি অন্তরে হিন্দু ছিলেন, অতএব আমরা হিন্দুরা বড়ো কম লোক নই। র্তাহার যে আত্মনিবেদন তাহাতে আমাদেরই ধর্ম ও সমাজের মহত্ত্ব। এমনি করিয়া আমরা নিজের দিকের দাবিকেই যত বড়ো করিয়া লইতেছি। তঁহার দিকের দানকে ততই খর্ব করিতেছি। বস্তুত তিনি কী পরিমাণে হিন্দু ছিলেন তাহা আলোচনা করিয়া দেখিতে গেলে নানা জায়গায় বাধা পাইতে হইবে- অর্থাৎ আমরা হিন্দুয়ানির যে ক্ষেত্রে আছি তিনিও ঠিক সেই ক্ষেত্রেই ছিলেন এ কথা আমি সত্য বলিয়া মনে করি না। তিনি হিন্দুধর্ম ও হিন্দুসমাজকে যে ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখিতেনতাহার শাস্ত্রীয় অপৌরুষের অটল বেড়া ভেদ করিয়া যেরূপ সংস্কারমুক্ত চিত্তে তাহাকে নানা পরিবর্তন ও অভিব্যক্তির মধ্য দিয়া চিন্তা ও কল্পনার দ্বারা অনুসরণ করতেন, আমরা যদি সে পন্থা অবলম্বন করি তবে বর্তমানকালে যাহাকে সর্বসাধারণে হিন্দুয়ানি বলিয়া থাকে তাহার ভিত্তিই ভাঙিয়া যায়। ঐতিহাসিক যুক্তিকে যদি পৌরাণিক উক্তির চেয়ে বড়ো করিয়া তুলি তবে তাঁহাতে সত্য নির্ণয় হইতে পারে। কিন্তু নির্বিচার বিশ্বাসের পক্ষে তাহা অনুকূল নহে। যেমনই হউক, তিনি হিন্দু ছিলেন বলিয়া নহে, তিনি মহৎ ছিলেন বলিয়াই আমাদের প্রণম্য। তিনি আমাদেরই মতন ছিলেন বলিয়া ঠাঁহাকে ভক্তি করিব তাঁহা নহে, তিনি আমাদের চেয়ে বড়ো ছিলেন বলিয়াই তিনি আমাদের ভক্তির যোগ্য। সেই দিক দিয়া যদি তাহার চরিত আলোচনা করি, তবে, হিন্দুত্বের নহে, মনুষ্যত্বের গীেরবে আমরা গীেরবান্বিত হইব। র্তাহার জীবনে সকলের চেয়ে যেটা চক্ষে পড়ে সেটা এই যে, তিনি যেমন গভীরভাবে ভাবুক তেমনি প্রবলভাবে কমী ছিলেন। কর্মের মধ্যে একটা অসম্পূর্ণতা আছেই- কেননা তাহাকে বাধার মধ্য দিয়া ক্রমে ক্রমে উদ্ভিন্ন হইয়া উঠিতে হয়- সেই বাধার নানা ক্ষতচিহ্ন তাহার সৃষ্টির মধ্যে থাকিয়া যায়। কিন্তু ভাব জিনিসটা অক্ষুন্ন অক্ষত। এইজন্য যাহারা ভাববিলাসী তাহারা কর্মকে অবজ্ঞা করে অথবা ভয় করিয়া