পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিচয় । ty শিশুত্ব আছে। এইজন্য জনসাধারণ নিজেকে শিক্ষা দিবার ও সাত্মনা দিবার নানাপ্রকার সহজ উপায় উদভাবন করিয়াছে। ছেলেদের ছেলেমানুষ যেমন নিরর্থক নহে- তেমনি জনসাধারণের নানাপ্রকার সংস্কার ও প্রথা নিরবচ্ছিন্ন মূঢ়তা নহে- তাহা আপনাকে নানাপ্রকারে শিক্ষা দিবার জন্য জনসাধারণের অন্তর্নিহিত চেষ্টা- তাহাই তাঁহাদের স্বাভাবিক শিক্ষার পথ। মাতৃহৃদয়া নিবেদিতা জনসাধারণের এই সমস্ত আচার-ব্যবহারকে সেইদিক হইতে দেখিতেন। এইজন্য সেই সকলের প্রতিষ্ঠাহার ভারি একটা স্নেহছিল। তাহার সমস্ত বাহারাঢ়তা ভেদ করিয়া তাহার মধ্যে মানব-প্রকৃতির চিরন্তন গুঢ় অভিপ্রায় তিনি দেখিতে পাইতেন । লোকসাধারণের প্রতি তঁহার এই যে মাতৃস্নেহ তাহা এক দিকে যেমন সকরুণ ও সুকোমল আর-এক দিকে তেমনি শাবকবেষ্টিত বাঘিনীর মতো প্রচণ্ড। বাহির হইতে নির্মমভাবে কেহ ইহাদিগকে কিছু নিন্দা করবে। সে তিনি সহিতে পারিতেন না- অথবা যেখানে রাজার কোনো অন্যায় অবিচার ইহাদিগকে আঘাত করিতে উদ্যত হইত। সেখানে তঁহার তেজ প্ৰদীপ্ত হইয়া উঠিত। কত লোকের কাছে হইতে তিনি কত নীচতা বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করিয়াছেন, কত লোক তঁহাকে বঞ্চনা করিয়াছে, তাহার অতি সামান্য সম্বল হইতে কত নিতান্ত অযোগ্যলোকের অসংগত আবদার তিনি রক্ষা করিয়াছেন, সমস্তই তিনি অকাতরে সাহা করিয়াছেন ; কেবল তঁহার একমাত্র ভয় এই ছিল পাছে তঁহার নিকটতম বন্ধুরাও এই সকল হীনতার দৃষ্টান্তে তাহার ‘পীপলদের প্রতি অবিচার করে। ইহাদের যাহা কিছু ভালো তাহা যেমন তিনি দেখিতে চেষ্টা করিতেন। তেমনি অনান্ধীয়ের অশ্রদ্ধাদৃষ্টিপাত হইতে ইহাদিগকে রক্ষা করিবার জন্য তিনি যেন তাহার সমস্ত ব্যথিত মাতৃহৃদয় দিয়া ইহাদিগকে আবৃত করিতে চাহিতেন। তাহার কারণ এ নয় যে, সত্য গোপন করাই তঁাহাব অভিপ্রায় ছিল, কিন্তু তাহার কারণ এই যে, তিনি জানিতেন অশ্রদ্ধার দ্বারা ইহাদিগকে অপমান করা অত্যন্ত সহজ এবং স্কুলবৃষ্টি লোকের পক্ষে তাহাই সম্ভব কিন্তু ইহাদের অন্তঃপুরের মধ্যে যেখানে লক্ষ্মী বাস করিতেছেন সেখানে তো এই সকল শ্রদ্ধাহীন লোকের প্রবেশের অধিকার নাই- এইজন্যই তিনি এই সকল বিদেশীয় দিঙনাগদের স্কুলহস্তাবলোপ হইতে র্তাহার এই আপনি লোকদিকে রক্ষা করিবার জন্য এমন ব্যাকুল হইয়া উঠিতেন, এবং আমাদের দেশের যে-সকল লোক বিদেশীর কাছে এই দীনতা জানাইতে যায় যে, আমাদের কিছুই নাই এবং তোমরাই আমাদের একমাত্র আশাভরসা, তাহাদিগকে তিনি তাহার তীব্ররোষের ব্যঞ্জশিখার দ্বারা বিদ্ধ করিতে চাহিতেন । এমন য়ুরোপীয়ের কথা শোনা যায় যাহারা আমাদের শাস্ত্ৰ পড়িয়া, বেদান্ত আলোচনা করিয়া, আমাদের কোনো সাধুসজ্জনের চরিত্রে বা আলাপে আকৃষ্ট হইয়া ভারতবর্ষের প্রতি ভক্তি লইয়া আমাদের নিকটে আসিয়াছেন ; অবশেষে দিনে দিনে সেই ভক্তি বিসর্জন দিয়া রিক্তহন্তে দেশে ফিরিয়াছেন। তঁহারা শাস্ত্ৰে । যাহা পড়িয়ছেন সাধুচরিতে যাহা দেখিয়াছেন সমস্ত দেশের দৈন্য ও অসম্পূর্ণতার আবরণ ভেদ করিয়া তাহা দেখিতে পান নাই। তাহদের যে ভক্তি সে মোহমাত্র, সেই মোহ অন্ধকারেই টিকিয়া থাকে, আলোকে अनेिल भrिउ लिन्न कान्न ना । 虽 কিন্তু ভগিনী নিবেদিতার যে শ্রদ্ধা তাহা সত্যপদার্থ তাহা মোহনহে-তাহা মানুষের মধ্যে দর্শনশাস্ত্রের শ্লোক খুঁজিত না, তাহা বাহিরের সমন্ত আবরণ ভেদ করিয়া মৰ্মস্থানে পীেছিয়া একেবারে মনুষ্যত্বকে স্পর্শ করিত । এইজন্য অত্যন্ত দীন অবস্থার মধ্যেও আমাদের দেশকে দেখিতে তিনি কুষ্ঠিত হন নাই। সমস্ত দৈনই তাহার স্নেহকে উদবোধিত করিয়াছে, অবজ্ঞাকে নহে। আমাদের আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা, বেশভূষা, আমাদের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকলাপ একজন য়ুরোপীয়কে যে কিরাপ অসহ্যভাবে আঘাত করে তাহা আমরা ঠিকমত বুঝিতেই পারিন, এইজন্য আমাদের প্রতি তাঁহাদের রাঢ়তাকে আমরা সম্পূর্ণই অহেতুক বলিয়া মনে করি। কিন্তু ছোটাে ছোটাে রুচি, অভ্যাস ও সংস্কারের বাধা যে কত বড়ো বাধা তাহা একটু বিচার করিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারি, কারণ, নিজেদের দেশের ভিন্ন শ্রেণী ও ভিন্ন জাতির সম্বন্ধে আমাদের মনেও সেটা অত্যন্ত প্রচুর পরিমাণেই আছে। বেড়ার বাধার চেয়ে ছোটাে ছোটাে কঁটাির বাধা বড়ো কমনহে। অতএব এ কথা আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে ভগিনী নিবেদিতা কলিকাতার বাঙালিপাড়ার এক গলিতে একেবারে আমাদের ঘরের মধ্যে আসিয়া যে বাস করিতেছিলেন, তাহার দিনে রাত্রে প্রতি মুহূর্তে বিচিত্র বেদনার