পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধরিয়া লইলে চলিবে না। যখনই রেখা ও প্রমাণের কথা ছাড়াইয়া ভােব লবণ্যের কথা পাড়া হইয়াছে তখনই বােঝা গিয়াছে গুণীর মনে যে ছবিটি আছে সে প্রধানত রেখার ছবি নহে তাহা রসের ছবি। তাহার মধ্যে এমন একটি । অনির্বাচনীয়তা আছে যাহা প্রকৃতিতে নাই। অন্তরের সেই অমৃতরসের ভাবছবিকে বাহিরে দৃশ্যমান করিতে পরিলে তবেই রসের সহিত রূপের সাদৃশ্য পাওয়া যায়, তবেই অন্তরের সহিত বাহিরের মিল হয়। অদৃশ্য তবেই দৃশ্যে আপনার প্রতিরূপ দেখে। নানারকম চিত্রবিচিত্র করা গেল, নৈপুণ্যের অন্ত রহিল না, কিন্তু । ভিতরের রসের ছবির সঙ্গে বাহিরের রূপের ছবির সাদৃশ্য রহিল না ; রেখা ভেদ ও এমাণের সঙ্গে ভাব ও লাবণ্যের জোড় মিলিল না ; হয়তো রেখার দিকে ত্রুটি রহিল নয়তো ভাবের দিকে- পরম্পর পরস্পরের সদৃশ হইল না। বরও আসিল কনেও আসিল, কিন্তু অশুভ লগ্নে মিলনের মন্ত্র ব্যর্থ হইয়া গেল। মিষ্টান্নমিতরে জন্যঃ, বহিরের লোক হয়তো পেট ভরিয়া সন্দেশ খাইয়া খুব জয়ধ্বনি করিল। কিন্তু অন্তরের খবর যে জানে সে বুঝিল সব মাটি হইয়াছে! চোখ-ভোলানো চাতুরীতেই বেশি লোক মাজে, কিন্তু, রূপের সঙ্গে রসের সাদৃশ্যবোধ যার আছে, চোখের আড়ে তাকাইলেই যে-লোক বুঝিতে পারে রসটি রূপের মধ্যে ঠিক আপনার চেহারা পাইয়াছে কি না, সেই তে রসিক। বাতাস যেমন সূর্যের কিরণকে চারিদিকে ছড়াইয়া দিবার কাজ করে তেমনি গুণীর সৃষ্ট কলাসীেন্দর্যকে লোকালয়ের সর্বত্র ছড়াইয়া দিবার ভার এই রসিকের উপর। কেননা যে ভরপুর করিয়া পাইয়াছে সে স্বভাবতই না দিয়া থাকিতে পারে না- সে জানে তন্নষ্টং যন্ন দীয়তে । সর্বত্র এবং সকল কালেই মানুষ এই মধ্যস্থকে মানে। ইহারা ভাবলোকের ব্যাঙ্কের কর্তা- এরা নানা দিক হইতে নানা ডিপজিটের টাকা পায়- সে টাকা বদ্ধ করিয়া রাখিবার জন্য নহে ; সংসারে নানা কারবারে নানা লোক টাকা খাটাইতে চায়, তাহদের নিজের মূলধন যথেষ্ট নাই- এই ব্যাঙ্কার নহিলে তাহাদের কাজ বন্ধ । এমনি করিয়া রূপের ভেদ প্রমাণে বাধা পড়িল, ভাবের বেগ লাবণ্যে সংযত হইল, ভাবের সঙ্গে রূপের সাদৃশ্য পটের উপর সুসম্পূর্ণ হইয়া ভিতরে বাহিরে পুরাপুরি মিল হইয়া গেল- এই তো সব চুকিল। ইহার পর আর বাকি রহিল কী ? কিন্তু আমাদের শিল্পশন্ত্রের বচন এখনাে যে ফুরাইল না! স্বয়ং দ্ৰৌপদীকে সে ছাড়াইয়া গেল। পাঁচ পার হইয়া যে ছয়ে আসিয়া ঠেকিল সেটা বর্ণিকাভঙ্গং- রঙের ভঙ্গিমা । এইখানে বিষম খটকা লাগিল। আমার পাশে এক গুণী বসিয়া আছেন তারই কােছ হইতে এই শ্লোকটি পাইয়াছি। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, রূপ, অর্থাৎ রেখার কারবার যেটা ষড়ঙ্গের গোড়াতেই আছে, আর এই রঙের ভঙ্গি যেটা তার সকলের শেষে স্থান পাইল, চিত্রকলায় এ দুটাের প্রাধান্য তুলনায় কার কত ? তিনি বলিলেন, বলা শক্ত । ፶ * র্তার পক্ষে শক্ত বৈকি! দুটির পরেই যে তীর অন্তরের টান, এমন স্থলে নিরাসক্ত মনে বিচার করিতে বসা তার দ্বারা চলিবে না। আমি অব্যবসায়ী, অতএব বাহির হইতে ঠাহর করিয়া দেখা আমার পক্ষে সহজ । রঙ আর রেখা এই দুই লইয়াই পৃথিবীর সকল রূপ আমাদের চােখে পড়ে। ইহার মধ্যে রেখাটাতেই রূপের সীমা টানিয়া দেয়। এই সীমার নির্দেশই ছবির প্রধান জিনিস। অনির্দিষ্টতা গানে আছে, গন্ধে আছে কিন্তু ছবিতে থাকিতে পারে না। এইজন্যই কেবল রেখাপাতের দ্বারা ছবি হইতে পারে। কিন্তু কেবল বর্ণপাতের দ্বারা ছবি হইতে পারে না। বর্ণটা রেখার আনুষঙ্গিক । y, সাদার উপরে কালোর দাগ এই হইল ছবির গোড়া। আমরা সৃষ্টিতে যাহা চোখে দেখিতেছি তাহা অসীম আলোকের সাদার উপরকার সসীম দাগ। এই দাগটা আলোর বিরুদ্ধ তাই আলোর উপরে ফুটিয়া উঠে । আলোর উলটা কালো, আলোর বুকের উপরে ইহার বিহার। কালো আপনাকে আপনি দেখাইতে পারে না। স্বয়ং সে শুধু অন্ধকার, দোয়াতের কালির মতো। সাদার উপর যেই সে দাগ কাটে অমনি সেই মিলনে সে দেখা দেয়। সাদা আলোকের পটটি বৈচিত্র্যহীন ও স্থির,